২০১২ সালে নতুনধারা পত্রিকার
২৫তম সংখ্যায় আর ২০১৪ সালে আদর্শ প্রকাশনী থেকে বই আকারে প্রকাশ।
মোহাম্মদ আজমের আলোচনা
[২০১৪ সালের
এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় আলোচনা সভায় মোহাম্মদ আজম এক
বক্তব্য দেন। এটি তার প্রথম এক-তৃতীয়াং।]
অল্প পরিসরে
বিপুল বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটিয়ে লেখা এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তানজিবুল হক তানু একজন
কলেজ শিক্ষক। তার ছোট ভাই সজিব র্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত দাগি আসামি। ভাইকে রক্ষা,
প্রেম রক্ষা, কৃষক বাবার স্বপ্নপূরণের সংগ্রাম। এসব বিষয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে তার
রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামও।
আমার মনে
হয় তারেক খান খুবই ভাল উপন্যাস লিখেছেন। ক্যাটাগরিক্যালি ভালো আর এটা রাজনৈতিক উপন্যাস।
ঢাকায় এ ধরনের রচনা খুবই কম। রাজনৈতিক মানে শুধু বিষয়বস্তুগত নয়, এর যে উপস্থাপন, বর্ণনাভঙ্গি,
এর যে দেখার দৃষ্টি, এর চরিত্রায়ণ, এর যে উন্নাসিকতা, ঘৃণা, যে ব্যক্তিগত নানা ধরনের
নিষ্পেষণ—এর সবকিছু গভীরভাবে রাজনৈতিক।
কন্ডম পলিসি
নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি কাজ করেছেন উৎপাদন-সম্পর্ক নিয়ে। রাষ্ট্র তার বিবেচনার
বিষয়। লেখক খুবই হুঁশিয়ার যে বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের জমি যথেষ্ট নয়। এমন
অবস্থায় পরিবার-পরিকল্পনা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের একটা পলিসি হওয়াই উচিত, বিনা পয়সায় কন্ডম
সরবরাহ করাই উচিত।
একই সঙ্গে
রাষ্ট্র আরেক কাজ করতে পারে। রাষ্ট্র র্যাব চালু করতেই পারে। নির্বিচারে, বিচারবহির্ভূতভাবে
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মানুষ কমিয়ে ফেলতে পারে।
এই যে নামের
মধ্যে একটা শ্লেষ, এটা তারেক খান ব্যবহার করেছেন। ব্যবহার করেছেন এমনভাবে যা প্রায়
একধরনের প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। কন্ডমের কথা এই গল্পের কাহিনির প্রথমেই আছে।
উপন্যাসের
প্রধান চরিত্র তানজীব যে ক্লাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ায়, তার আলোচনায় আছে। এই উপন্যাসের
নাম তিনি কনডম পলিসি দেবেন কিনা তা নিয়ে উপন্যাসের মধ্যে বিচিত্রভাবে, কখনও শ্লেষ,
কখনও তরুণ-তরুণীদের সাথে শিক্ষকের রসাত্মক হাসিঠাট্টা।
উপন্যাসের
ঘটনাগুলো তিনি দু-চার দিনের মধ্যে শেষ করেছেন লেখক। এর যে প্রধান চরিত্র বা নায়ক সে
এই সময়টার প্রতিটা মুহূর্ত একেবারে বাস্তব অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে এবং এসব
বাস্তবতার মধ্য দিয়ে লেখক অতীত নিয়ে আসছেন, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে আসছেন এবং সব বিচার-বিশ্লেষণ
নিয়ে এসেছেন। এটাও লেখকের একটা মুন্সিয়ানার ব্যাপার।
তানজীবই এ
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, একমাত্র চরিত্র। অন্য চরিত্রগুলো পরোক্ষভাবে ওই তানজিবের
মাধ্যমে, তার সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে, তার চোখ দিয়ে, তার বিবেচনা থেকে এবং বৃহত্তর কাঠামো
বা আকারের সঙ্গে সে যেভাবে এই চত্রিগুলো সম্পর্কিত করছে সেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। আলাদাভাবে
বর্ণিত হয়নি। তবে চরিত্রগুলো আলাদা করে দেখা যায়। যেমন, তানজীবের বাবাকে পাওয়া যায়,
তানজীবের মাকে পাওয়া যায়, ভাইকে পাওয়া যায় যারা গ্রামে থাকে। তাদের যে আকাক্সক্ষা,
সন্তানদের সাথে তাদের যে সম্পর্ক এবং তাদের নিয়ে তাদের যে হতাশা এমনকি তাদের গ্রামের
আশপাশের গ্রামে আরও যারা আছে, তাদের কথা এসেছে, তাদের সন্তানদের সাপেক্ষে নিজেদের সন্তানদের
সম্ভাবনা—এসব হয়ত সাকল্যে পৃষ্ঠা দুয়েক হবে। কিন্তু টের পাওয়া যায়। এটা আমার কাছে খুব
উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে।
ছোট কাহিনির
মধ্যে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে। বিষয়ের বিস্তারটা বিরাট; যথেষ্ট বেশি। খুবই
নির্মমভাবে সমাজতাত্ত্বিক বাস্তবতা উপস্থানা। এ কথাটা আমরা আখতারুজ্জামানের উপন্যাস
সম্পর্কে বলি। তারেক খানের এ উপন্যাসের ব্যাপারটা যদিও সে রকম নয়, এখানেও নানা ধরনের
নিখুঁত বাস্তবতা, ডিটেল বাস্তবতা সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যঞ্জনা বা প্রতীকের মাধ্যমে এসেছে।
ওই ছোট্ট আয়তনের মধ্যে বিস্তারটা হয়েছে অনেক বড়। আছে ব্যক্তি ও সমষ্টি, আছে গ্রাম,
আছে ঢাকা শহর, আছে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতির লোক যারা রাষ্ট্র চালায় এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক
সম্ভাবনা, চরিত্রের সাথে উৎপাদন সম্পর্ক। এ রকম বড় আকারে তিনি কাজ করেছেন।
এর আরও একটা
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এর আগে আমি বান্ধাল (২০১০) পড়ার সময় এবং আলোচনার সময়ও দেখেছি, সেটা হল এর উৎপাদন সম্পর্ক।
আরেকটা বিষয়
যেটা আমি বলে থাকি, ঢাকার লেখকেরা একেবারে বাদ রেখে যান, সেটা হল—একটা চরিত্র কিভাবে
উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ওই সম্পৃক্ততার বশে অ্যাকশন বা রিঅ্যাকশনের সাথে
যুক্ত হয়।
উৎপাদন সম্পর্ক
ওই চরিত্রের মাধ্যমেই চেনা যাচ্ছে। যেটা তারেক খানের বান্ধালেও আছে। তার নানান ধরনের
অবস্থানসহ, যেটা শুধু শ্রেণি নয়। এই যে বিস্তারটা ছোট্ট উপন্যাসের মধ্যে এটাই এ উপন্যাসে
শক্তির জায়গা। বাক্য, আধা বাক্য, শব্দের মধ্যেই চেনা যাচ্ছে। এটা বিরাট ব্যাপার।
এই কাজটা
তারেক করল কিভাবে? বলছি যে এখানে কোনো কাহিনি নেই, এখানে চরিত্রায়ণ নেই, আয়তন ছোট।
এই কাজটা তারেক করেছে অনেক বছর আগের একটা সাহিত্যপদ্ধতিতে। স্টিম অব কনশাসনেস পদ্ধতিতে
যেটা একটা অত্যন্ত পরিচিত সাহিত্যরচনা পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। স্টিম অব কনশাসনেস একটা
জটিল পদ্ধতি যা বাক্যে, ভাষায় সৃষ্টি হয়।
কলকাতা বা
ঢাকায় আমি খেয়াল করেছি, যেসব উপন্যাস স্টিম অব কনশাসনেস পদ্ধতিতে লেখা বলে বর্ণনা করা
হয়েছে সেসব আসলে স্টিম অব কনশাসনেস নয়। স্টিম অব কনশাসনেস একটা জটিল পদ্ধতি যেটা কাহিনিক্রম
লঙ্ঘন করে, সময়ক্রম লঙ্ঘন করে, স্বাভাবিক ন্যারেটিভ ভঙ্গিকে লঙ্ঘন করে। ব্যক্তির নিজের
মনোজগতের নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিত, প্রধানত অনিয়ন্ত্রিত, জ্ঞাত ও অজ্ঞাত, প্রধানত
অজ্ঞাত চিন্তাচেতনাকে সরাসরি বাক্যে শব্দে ধরার একটি পদ্ধতি।
এদিক থেকে
আমি বলব, অনেক বিলম্বে হলেও একটা পুরনো টেকনিক ব্যবহার করলেও তারেক খান সফলভাবে ব্যবহার
করেছেন। অংশবিশেষ নয়, এ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ শব্দ পর্যন্ত স্টিম অব কনশাসনেস পদ্ধতিতে
লেখা।
এই পদ্ধতিই
তারেককে সাফল্য এনে দিয়েছে এই ছোট্ট আকারের মধ্যে অনেক বড় জায়গাকে ধরতে।