কারে আমি খুঁজে মরি

তারেক খান


আমি এখন শাহেরাকে খুঁজতে বেরোব। আর কিছুদিনের মধ্যেই তাকে আমি পেয়ে যাচ্ছি।
যেমনটা আমি জানতাম অন্য অনেকের কথা, আমারও তেমনি মনে হল, শাহেরাকে আমি যুগ যুগ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আর হঠাৎ করেই পলাশির মোড়ে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় তাকে আমি পেয়ে গেলাম।
সে আবার হারিয়ে যেতে পারে এ আমি ভাবতেই পারিনে।
মোটে কয় মিনিটের প্রথম সাক্ষাৎ বলে তখন তার ঠিকানা চাওয়া সংগত ছিল না কিন্তু যেহেতু তাকেই আমি যুগ যুগ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, আমাদের শিমুলগাঁও ও তার আশপাশে যখন যেখানে গেছি, বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে অথবা দড়ি ছিঁড়ে পালানো এঁড়েটার খোঁজে, তখন ত আমি মূলত শাহেরাকেই খুঁজেছি। উপজেলা শহর লোহাগড়ায় চাকুরে চাচার বাসায় যখন বেড়াতে যেতাম, নবগঙ্গার ধারে লম্বা পাড়াটায় আমি ত শুধু তাকেই খুঁজে বেড়াতাম।
শেষ পর্যন্ত তাকে পাই ঢাকা কলেজে পড়ার সময় যেহেতু সে ঢাকা থাকে কিন্তু ঢাকার ঠিক কোন জাগায়, এতদিন পর সে ত নিছক ঠিকানার অভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। তবে ঠিকানা চাইতে না পারলেও কথার কথা এটুকু ত বলা যায়, আপনি ত একেবারে ভিজে গেছেন, যাবেন কই?
সে তখন লালমাটিয়া বলেছে, যা আমি সত্য বলে নিশ্চিত হয়েছি তার টোন শুনে। আর কোনো কথা বলার সুযোগ হল না। একটা বাস এসে তাকে যেন ছো দিয়ে নিয়ে গেল।
সুতরাং লালমাটিয়াই অবলম্বন।
প্রথম দিন ভাবিনি আমি তাকে খুঁজে পাব। লালমাটিয়ায় সে হয়ত তার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে যাচ্ছিল। হয়ত সে তার মনের মানুষের কাছে যাচ্ছিল। তবু দুচার দিন খুঁজলে দোষ কী।
এক সপ্তার ব্যবধানে দ্বিতীয় দিন আমি খুঁজতে পারি লালমাটিয়া মহিলা কলেজের গলিতে। কলেজছাত্রীদের পোশাক দেখে আমার চোখে ভাসল তার সাদা সালোয়ার-কামিজ। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। ড্রেসকোডের কড়াকড়ি না থাকলে এমন একরঙা সাদা পোশাক কেউ পরে নাকি।
দ্বিতীয় দিনটা আমি কলেজ গলিতেই ঘুরঘুর করে কাটিয়ে দেব কেননা আমার মন বলছে সে এ কলেজেই পড়ে। তবু প্রায় দুই সপ্তা ওদিকে আর যাইনি। আর যাব কিনা তাও সচেতনে ভাবিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তৃতীয় দিনের মত চলে গেলাম। আমি একটুও সিরিয়াস না অথচ প্রায় দেড় মাস পরে আবার। এই যাওয়া দিনে দিনে যেন আমার নিয়তি হয়ে উঠল। কখনও দুচার দিন পরপর, কখনও পরপর তিনদিন। যেতে থাকব অনন্ত কাল?
আমি বোধহয় হতাশ হব না।
তবে কি তুমি একটা গাধা হবে?
হয়ত তাই। নিজেকে পাগল মনে হত প্রায়ই। এমনটা যেন কিছুতেই হবার নয়, যেকারণে ঢাকার ধুলো আর ধোঁয়ার মধ্যে ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে কেটে খোঁজাখুঁজি ছিল ক্লেশকর কিন্তু দুই বছর খোঁজার পর কলেজের গেটের সামনে তাকে দেখামাত্রই আমার মনে হল, মোটে দুই মিনিট আগে আমরা ছিলাম পলাশির মোড়ে।
সেই হাসি, সেই মুখ, বইধরা সেই হাত আর সেই ভঙ্গিমা। দুই বছর পর পরিচয়ের ক্লু ধরিয়ে দিলে সে আমাকে সহজেই চিনতে পেরে যেমন বিস্মিত তেমনি উচ্ছ্বসিত। কিভাবে খুঁজে পেলাম তাই নিয়ে তার প্রথম প্রশ্ন এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিঞ্চিৎ আত্মদ্বন্দ্ব, সে আমাকে কলেজের নাম বলেছিল কিনা মনে করতে পারছে না। পরে সে আমার ক্যালকুলেশন দেখে অবাক আর আমার আত্মবিশ্বাস দেখে মহা খুশি।
ঢাকা আমার ভাল লাগতে শুরু করল।
তুমি আসলে তার মধ্যে হারিয়ে গেলে।
তাকে পেয়ে আমার মুখে যেন খৈ ফুটতে শুরু করল আর আমি আমার অজানতেই ভাবতে লাগলাম, আমার এই খোঁজাখুঁজির সাধনায় সে খুব মুগ্ধ কিন্তু হঠাৎ সে যেন একেবারে নীরব হয়ে গেল, যার মানে হল সে বুঝতে পারছে আমি কেন তাকে দুই বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি যা সে একটুও চায় না। আমি সেটা বুঝতে পারি আর আমার চোখমুখ মেঘে ঢেকে আসে যা সেও বুঝতে পারে, তবু আমি একটুও থামতে চাইনি, বরং জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম, সে এবার বিএ ফার্স্ট ইয়ার আর আমি আগবাড়িয়ে বলে রাখলাম, আমি এমএ ফার্স্ট ইয়ার, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা কলেজ। কিন্তু সে আর একটা কথাও না বলে হঠাৎ লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে পড়ল আর আমি ভগ্নমনে ধানমন্ডির চোদ্দ নম্বরে গেলাম ডানাকে পড়াতে।
কি ন তু।
ডানা কি আমাকে আসলে টিচার হিসেবে চাইছে নাকি অন্যকিছু তাই নিয়ে আমি অনবরত চিন্তিত। দৈনিকই প্রথম বিষয়টা আলোচনার মাঝপথে সে একটা প্রেমের প্রসঙ্গ পাড়ে আর পড়াশুনার প্রসঙ্গে বলে, আপনার কি ধারণা আমি একটি গাধীছাত্রী আর আপনার কাছে পড়ে পড়ে আমাকে পাশ করতে হবে?
তা ঠিক। সে যখন আট ক্লাসে পড়ত তখন একজন টিচার তার দরকার ছিল বটে, এখন সে “ইংরেজিতে সম্মান” করছে। এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে এমন ত শুনিনি।
এসব সচেতনে চিন্তার পর আমার আর একদিনও এখানে টিউশনি করা উচিত না বলে ভাবি কিন্তু আমি দৈনিকই মোটামুটি যথাসময় এসে পড়ছি আর পুরো দেড় ঘণ্টা বসে থেকে থেকে বেতন নিয়ে যাচ্ছি, এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবছি না শাহেরা-ঘোরে আটকে আছি বলে নাকি কবিতার কানের দুলে দুলছি বলে সেটা আমাকে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।
আমি ভাবছি।
চার মাস ধরে আমি তুমাকে কী শেখালাম? আমি প্রশ্ন করলে তার তাৎক্ষণিক জবাব হল, সেটা ত শিক্ষকেরই ভাল জানার কথা।
এ রকম স্মার্ট মেয়ে যখন প্রেমে টইটম্বুর হয় তখন আমার বন্ধুদের চুলচেরা বিশ্লেষণে পাওয়া বিজ্ঞ মন্তব্য ‘মেয়েদের কঠিন হৃদয়’ ‘কৈমাছের পরান’ ‘উপরন্তু বড়লোকের মেয়ে’ ইত্যাদি সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি কিন্তু পরে সে যখন বলে সে আমাকে দেখার প্রথম দিন থেকেই ভালবাসে, যেদিন তাকে প্রথম পড়াতে গেছিলাম সে আট ক্লাসে পড়ার সময়, আমি ধরে নিই এটা হল এক প্রকার ঘোর।
ভালবাসা কাকে বলে? ভাবলাম তাকে বুঝিয়ে নিরস্ত করব। কিন্তু সে বলে কিনা, আই ফিল ইউ। আই লাইক ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ।
হোয়াট ইজ ফিলিং?
সে সবকিছু খুব সূক্ষ্মভাবেই বোঝে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে শুধু আমাকেই চায়। তাকে কোনোভাবে নিরস্ত করতে না পেরে আমি খুব শক্ত করে বলে দিলাম, আমি শুধু শাহেরাকেই চাই।
কবিতার কানের দুল ত অলীক ভাবমাত্র।
কি ন তু।
ডানা থামল না। আমি তাকে পড়াতে যাওয়া বন্ধ করে দিলে সে আমার নর্থ হলে এসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘পড়াতে যান না ক্যা? আমাকে ফেল করাতে চান বুঝি?’
‘কী মুশকিল। তুমি কি গাধীছাত্রী যে আমার কাছে পড়ে পড়ে তুমাকে পাশ করতে হবে?’
ডানা আরো হাসে। তবু আমার আর ওখানে যাওয়া উচিত না, আমার বুদ্ধি আমাকে সতর্ক করে দিল। কিন্তু আমি গেলাম। না গিয়ে আমার যেন উপায় নেই। আমি এত অস্থির কেন, শাহেরা জানতে চায়। আমার ভিতর সে কোথায় অস্থিরতা দেখল। আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাই।
‘আমি বললাম আর অমনি আপনি চলে আসলেন? আমাকে না চাইলে আর আসবেন না।’ ডানা ঠিক বলল। আমি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। সে আবার এল। না এসে তার উপায় নেই?
আমি আবার যেতে শুরু করলাম। এটা অস্থিরতা তা আমি জানি। কিন্তু শাহেরা আমার ভিতর কোথায় অস্থিরতা দেখল।
দৈনিক সন্ধেবেলা পড়াতে গিয়ে আমি যখন ডানার বক্ষসৌন্দর্য অবলোকন করি তখন আমার মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকায় আর কবিতার কানের দুল আমার চোখের সামনে যুক্তিহীন দুলতে থাকে এবং ওই দোলে আমিও যুক্তিহীন দুলতে থাকি আর কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই শাহেরাকে বলি, তুমি কেন কানের দুল পর না? একথা ভুলেও যেন ডানাকে না বলি সেদিকে সতর্ক থাকি সব সময়। আমার ধারণা তাকে বললে সে তখনই পরা শুরু করবে এবং সব সময় পরে থাকবে যা আমি চাই না, যা চাই শুধু শাহেরার কানে এবং শাহেরা মৃদু হেসে ‘মাঝে মাঝে পরি ত’ বললে আমি সোজা ইস্টার্ন প্লাজায়। এক ডজন কানের দুল কিনে শাহেরার সামনে হাজির হই কিন্তু শাহেরা আমাকে কানের দুলে না দুলিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, এখনও নাকি আমাদের মধ্যে গিফট দেওয়া-নেওয়ার মত সম্পর্ক হয়নি। তবে ডানাকে যখন বলি, শাহেরাকে আজ আমি একটা কানের দুল গিফট করেছি তখন তার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে যায় কিন্তু শাহেরাকে যখন বলি, ডানা নামে আমার একটা দারুণ সুন্দরী বান্ধবী আছে তখন তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখি না। তিন বছর পরও না।
আমি মরিয়া হয়ে অপেক্ষায় থাকি, কবিতার মত মৃদু হেসে শাহেরাও বলবে, তুমি আমার দিকে এমন করে চেয়ে থাক কেন। অথচ শাহেরা যেন অতিষ্ঠ হয়েই বলল একদিন, তুমি কি আসলেই আমাকে চাও?
তার চোখ ভরা এমন সন্দেহ যেন তার জন্য আমার ভালবাসা সম্পূর্ণ অলীক। সে বলে, সে ভাবে আমার কথা কিন্তু বুঝতে পারে না কেন একপা বাড়ালেও দুপা পিছিয়ে যায়। আমিও ভাবি কিন্তু কবিতার কানের দুলের কথা আমি তাকে কিছুতেই বলতে পারি না, বরং খুব জোর দিয়েই বলি, এতদিন ধরে তার পাছে ছুটে বেড়াচ্ছি, দুই বছর ধরে খুঁজে খুঁজে হয়রান হলাম, তবু তার সন্দেহ, আমাকে নিশ্চয় তার পছন্দ হচ্ছে না সেকথা বলে দিলেই ত পারে, তখন শাহেরা শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যা আমার প্রেমশূন্য হৃদয়ের হাহাকার বাড়িয়ে দেয়। এই অবস্থার মধ্যে শাহেরা বলে কিনা, ভালবাসা কাকে বলে।
জানি না। আমি শুধু জানি, আমি তুমাকে চাই। আই ফিল ইউ। আই লাইক ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ।
শাহেরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
আমি আমার দুই বছরের সিনিয়র কলেজ টিচার হাশেম ভাইয়ের কথামত ভালমত চিন্তা করি, আমি কী চাই সেটা আমাকে ভাল করে বুঝতে হবে এবং শাহেরার সন্দেহের কারণ খুঁজতে হবে। তখন অনেক চিন্তার পর আমার মনে হল, আমি শুধু শাহেরাকেই চাই। কবিতার কানের দুল আমাকে দুলিয়ে মারলেও কখনও ভাবিনি শাহেরাকে আমি চাই না কিন্তু শাহেরা যখন বলে, তুমি আমাকে ভালবাস কেন তখন আমি আবারও কারণ খুঁজতে মাঠে নামি এবং অনেক দিন পরে দেখি জীবত্বের পরতে পরতে স্যাঁতসেঁতে পরমাণু থিকথিক করছে যা আমাকে সাময়িক হতাশ করে কিন্তু আমি অনুভব করি আমি তাকে চাই, আমি তার স্যাঁতসেঁতে নরম মাটিতে ক্লেদাক্ত হতে চাই অথচ তা আমি তাকে বলতে পারি না। কদিন ধরে চিন্তা করে মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখে একদিন দেখা হতেই বললাম, তুমি আমার মনের কোণে জেগে থাক চিরসজীব ফুলের মত। আমি তুমাকে—। আমার কথা শেষ হবার আগেই তার নীরব কণ্ঠের প্রতিক্রিয়া, ফুল শুকিয়ে গেলে কী করব।
আমি একটা ‘দারুণ’ উত্তর দিলাম, এ ফুল ত সে ফুল না। এ ফুল কোনো দিন শুকোবে না। একবার এর সংস্পর্শে এলেই আমরা অমর হয়ে যাব। আমি ভেবেছিলাম এমন উত্তরে সে খুশি হবে। হয়ত চোখ বড় করে তাকাবে অথবা মজা করার জন্য হেসে খুন হবে, যেমনটা তার স্বভাব, অথবা গদগদ হয়ে কাছে ঘেঁষে বসবে যা আমি আশা করি, যদিও তখন পর্যন্ত এমনটা কোনো দিন ঘটেনি। সে বরং জানতে চায়, সে যখন আমার মনের কোণে জেগে থাকে তখন তাকে নিয়ে আমি কী করি।
কী বলি। তার কণ্ঠ এমন নিস্পৃহ যে আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। এই নিস্পৃহতা আমাকে তোলপাড় করে। যেন যুগ যুগ। ফলে আমি মাঝে মাঝেই বিভ্রান্ত হই এই ভেবে যে, সে কি দেখতে পায় কবিতার কানের দুল আমাকে কিভাবে দোলায় এবং একারণেই কি সে এমন নিস্পৃহ থাকে।
মাঝে মাঝেই শঙ্কিত হই, ডানা হয়ত নিজে বা চর লাগিয়ে শাহেরাকে খুঁজে বের করে সরে যেতে বলেছে।
আমি ভাবতে শুরু করলাম সত্যিই এমনটা ঘটেছে। যদি সত্যি হয় তাহলে ডানা ঠিক কী বলেছে। যদি বলে থাকে সে শুকুর আলিকে ভালবাসে তাহলে এক, যদি বলে থাকে শুকুর আলি তাকে ভালবাসে তাহলে আর এক।
বিষয়টা নিয়ে আমাকে ভাল করে ভাবতে হবে।
প্রথমত, ডানা যদি শাহেরার সাথে দেখা করেই থাকে তাহলে শাহেরা প্রসঙ্গটা আমার কাছে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। শাহেরা এমন কোনো প্রসঙ্গ তোলেনি। ধরা যাক ব্যতিক্রম হিসেবে শাহেরা প্রসঙ্গটা আমার সামনে তুলল না বা দূর ভবিষ্যতে তুলবে ভাবল।
দ্বিতীয়ত, ডানা যদি বলে থাকে সে শুকুর আলিকে ভালবাসে তাহলে...এমন অনেক ডানা-পাখনাই ত শুকুর আলিকে ভালবাসতে পারে, তাতে শাহেরার কী। শুকুর আলি ত শাহেরাকেই চায়। এতটুকু বোঝার বুদ্ধি ত শাহেরার আছেই।
তৃতীয়ত, ডানা যদি বলে থাকে শুকুর আলি তাকে ভালবাসে তাহলে শাহেরা আমার সামনেও আসবে না এটাই স্বাভাবিক।
আমি আরো জোরে শাহেরার পাছে ছোটা শুরু করি আর ডানার দিকে নির্বিকার চোখে চেয়ে থেকে বলি, আমি শুধু শাহেরাকেই চাই। তখন সে আমার কাঁধে হাত রেখে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়, বলে, তুমাকে হারানুর আশঙ্কায় বুকের ভিতর কেঁপে কেঁপে ওঠে। বলার সময় মাঝে মাঝেই কাঁদে আর নিদারুণ অসহায় চোখে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে যখন আমাকে বলতেই হয়, কেন এত ভালবাস আর কেনইবা এত ভয় পাও।
শাহেরা যেমন আমাকে বলে আমিও তেমনি ডানাকে বলি, ভালবাসা কী চিজ যার জন্য এত ব্যাকুল হতে হয়?
ডানা চোখ মুছতে মুছতে বলে, আমি খুব বোকা আর খুব দুর্বল, তাই না?
শাহেরাকে হারানোর ভয়ে আমি যেমন স্নায়ুচাপে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি, ডানারও তেমনি কোনো অনুভূতি হচ্ছে কিনা ভাবতে ভাবতে তার মুখের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাখি।
শাহেরা, তুমি কেন ডানার মত ভালবাস না।
শাহেরার সাথে তৃতীয়বার দেখা হতে আমার সময় লাগে বত্রিশ দিন। দ্বিতীয়বার দেখা হবার পরদিন থেকে দৈনিক সকালে কলেজ শুরুর আগেই হাজির হই আর দুপুর আড়াইটা-তিনটা এমনকি সাড়ে চারটা পর্যন্ত কুয়াশার মত ধুলোঢাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি গেট বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত, নজর রাখি গেট ও আশপাশে। যদিও আমি ভেবেছিলাম প্রথম দিনই তাকে পেয়ে যাব অথচ দ্বিতীয়-তৃতীয় করে যখন সপ্তম দিন পার করি তখন আমি হতাশ হই এবং আরো মনোযোগী হই এই ভেবে যে আমার নজর ফসকে যাচ্ছে। সত্যিই আমার নজর ফসকে গেছিল বলে জানতে পারি, শাহেরা যখন বত্রিশ দিনের মাথায় আমার মুখোমুখি হলে মিষ্টি হেসে বলে, সে আমাকে বেশ কদিন দেখেছে কিন্তু টুপ করে কেটে পড়েছে। এদিন সে আমার পুরো প্রোফাইলটা নিয়ে নিলে আমি ভাবলাম আমার শ্রম সার্থক এবং দিন দিন ভাবতে লাগলাম, আমার পুরো জীবনটাই সার্থক, কেননা তাকে অথবা তার মত কাউকে ত আমি আজ থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি না। আট ক্লাসে পড়ার সময় কবিতার কানের দুল আমাকে এত বেশি দুলিয়েছিল যে আমি তা এখনও ভুলতে পারিনি কিন্তু সে ত অলীক স্বপ্নমাত্র।
আমি আমার প্রোফাইল বলতে বলতে শাহেরার অনুভূতি খেয়াল করি যা আমাকে আরো উজ্জীবিত করে। সে যেন ফুরফুরে মেজাজেই বলল, তার বাপ কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, মা স্কুলটিচার আর সে এখন বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে একেবারে গলদঘর্ম।
হ্যাঁ, তা তুমার গলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
তাই নাকি?
আক্ষরিক অর্থেই।
কথা বলতে বলতে আমি ভাবছিলাম চা খাওয়ার কথা বলব কিনা। তার সাথে চা খাওয়ার দৃশ্যটা আমার কাছে রোমান্টিক কল্পনা ছিল কয়েক বছর ধরে, তার মত কারো সাথে আরো অনেক বছর। রোমান্টিক বলেই তখন এটা তাকে বলতে পারিনি আরো দেরি করা উচিত মনে করে কিন্তু আবার দুশ্চিন্তা দেখা দিল মাত্র মিনিট ছয়েক পরেই যখন সে যাই বলে পা বাড়াল এবং আমি তার ক্লাসরুটিন চেয়ে নিরাশ হলাম। তখন আমার চোখমুখ কালো হয়ে গেল এই ভেবে যে আবারও সময় নষ্ট হবে এবং এমএ পরীক্ষায় আমি আর ভাল করব না, অথচ ভাল আমাকে করতেই হবে। তবে সে যখন দারুণ হেসে বলল, রুটিন ছাড়া কি আমি তাকে খুঁজে পাব না তখন আমি আবার উজ্জীবিত হই। সে আমার ধৈর্য পরীক্ষা করছে যেখানে আমাকে পাশ করতে হবে। পরদিন কলেজে গিয়ে শুনলাম, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উপলক্ষে সব ক্লাস এক মাস বন্ধ থাকবে যাতে আমি যারপরনাই হতাশ হলেও ভাবলাম, এই এক মাসে আমার পড়াশুনা ভাল করে এগিয়ে নিতে পারব কিন্তু এটা ছিল ভাবনা পর্যন্তই যা আমি পরদিনই বুঝতে পারি শাহেরার কাছে যাবার জন্য রাজাবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়ে, যেহেতু শাহেরা মিষ্টি হেসে বলেছিল সে তার বাপ-মার সাথে রাজাবাজার মসজিদের গলিতে একটা তিনতালা বাড়ির দোতালায় ভাড়া থাকে।
আমি ভেবেছিলাম শাহেরাকে হয়ত কোনো বাড়ির ব্যালকনিতে দেখতে পাব, হয়ত দেখব সে কোনো বাড়ির গেটে বা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এবং এও ভেবেছিলাম, হয়ত আর কোনো দিন তাকে দেখতেই পাব না। তবু আমি সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত গ্রিনরোড থেকে মিরপুর রোড পর্যন্ত আর পান্থপথ থেকে মানিক মিয়া এভেনু পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল রাজাবারে হাঁটুসমান আবর্জনার মধ্যে পা ডুবিয়ে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়াই শাহেরাকে। আট-দশ ফুট চওড়া গলির দুপাশে বস্তির সারির মত ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে থাকা উচ্ছিষ্টমাখা পাঁচ-দশ তালা ভবনগুলোয় চোখ বুলাতে বুলাতে, ইট ওঠা এবড়োখেবড়ো রাস্তায় নর্দমা উপচানো পানি থেকে পা বাঁচিয়ে, উচ্ছিষ্ট ডিঙিয়ে আমি খুঁজে বেড়াই শাহেরাকে কিন্তু সন্ধে হয়ে এলে মনে পড়ে ডানার কথা।
ইদানীং আপনি সন্ধে করে আসছেন কেন, সার? প্রশ্নটা সে ইদানীং দৈনিকই করছে। একই প্রশ্ন দৈনিক করার মানে কী সে আমি জানি, নিছক প্যাঁচাল যা তার আসল উদ্দেশ্য আমাকে নিয়ে আর আমিও যেন তার একটা উত্তম উদ্দিষ্ট, তবে ইদানীং আমি প্রথমে অনেকখন চুপ থাকি, একা একা সে কতটুকু প্যাঁচাল পাড়তে পারে দেখতে চাই কিন্তু সে সেটা বুঝতে পেরে বলে, সে একা কথা বলতে পারে, আমি চুপ থাকলেও তার কোনো সমস্যা নেই। আমিও আমার কোনো সমস্যা দেখিনে, তবে পঞ্চম মাসের বেতন পাওয়ার পর আমি আর চুপ থাকতে পারিনে।
ডানার বিষয়টা প্রথম বারের মত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম।
বন্ধুরা আমাকে উল্লসিত হয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরে এ ত দেখছি সোনার খনি পাইছে রে। তারপর তারা আমার ইন্টারভিউ নেয় আর আমিও ঠিক ঠিক উত্তর দিই বিষয়টা ঠিক ঠিক বোঝার জন্য।
সত্যিই তাই। মিরপুরের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, গাজীপুরের টেক্সটাইল মিল, নারায়ণগঞ্জের স্টিল মিল...তবে আমাকে লোভ ধরায় মূলত ধানমন্ডির বাড়িটা। বন্ধুরা হল্লা করে এবং নিশ্চিত হয় যে আমি খুব শীগগীরই বড়লোকের ঘরজামাই হতে যাচ্ছি, হয়ত এক মাস পরে আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই। সেই আনন্দে তারা সেদিন রাতেই তাদের প্রিয় রেস্টুরেন্ট নোংরা পুরান ঢাকার নীরবে যায় নোংরা ঘিঞ্জি গলিতে এক রিকশায় চারজন রিংবেল ক্রিং ক্রিং করতে করতে। আমার পকেট মাস শেষের আগেই ফাঁক করবার আয়জন আরকি। কিন্তু আমি কিছুতেই ডানার দিকে ঝুঁকতে পারিনে। বন্ধুদের কোনো কথা বা ডানার কোনো কথায় আমি কখনও কান দিইনি কেননা কানের যে মূলকেন্দ্র সেই চিন্তাচেতনা সব ছিল শাহেরার দিকে অথচ শাহেরার কথা বন্ধুদের বললেই তারা আমাকে শক্ত করে ধমক দেয়। মহিবুল আরো একধাপ এগিয়ে বলে, শালার বিটা শালা রাজ্যসহ রাজকন্যা পাইছে, তবু শাহারা মরুভূমির মধ্যি হাবুডুবু খাচ্ছে।
আমিইবা কেন ডানাকে ছাড়ছিনে।
এই সময় এক হ্যান্ডসাম যুবক ডানাকে যেন একেবারে সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরল। আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
যুবকটাকে বেকুব মনে হলেও চোখের সামনে শাহেরার গা ঘেঁষে আমার প্রথম বসার দৃশ্য, তার পিঠের উপর হাত দিয়ে বুকের সাথে আগলে ধরেছি, শাহেরা আবেগে আপ্লুত, আমি তার গলার নিচে দিয়ে বুকের দিকে তাকাচ্ছি, যা শাহেরা নিজেও খেয়াল করেছে বলে আমি নিশ্চিত এবং আমি মরিয়া হয়ে আশা করেছি, কবিতার মতই শাহেরা যেন বলে, তুমি কেন এমন করে চেয়ে থাক।
শাহেরা যেন পণ করেছে এমন কিছু সে কোনো দিনই বলবে না।
তখন আমার খুব মনে পড়ে শাহেরাদের বাসায় তার মামাত জাহিনের ঘন ঘন আসা-যাওয়া। যদিও জানি মেয়েদের সন্দেহ করলে তারা সেটা সহজভাবে নেয় না, তবু আমি না বলে পারি না যে ওই লোকটা তুমাদের বাসায় এত ঘন ঘন আসে কেন শুনি? আমি যখনই জিজ্ঞেস করি, শাহেরা তখনই লাজুক হাসে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না আর আমিও ধরে নিই, আমি তাকে চাইলেই পাই কিন্তু আমি আরো অগ্রসর হয়ে দেখি আমার ধারণা ভুল।
আমি তখন বিয়ের কথা বলি কিন্তু খেয়াল করি শাহেরা চিন্তিত হয়ে পড়ছে যার কারণ হিসেবে সে বলে, আমার ভিতর সে নাকি বেশকিছু বৈপরীত্য লক্ষ করেছে যা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শাহেরা নাকি খেয়াল করেছে সে যখন বেশি আগ্রহী হয় তখন আমি ঝিমিয়ে পড়ি কিন্তু আমি যখন জোর দিয়ে বলি, তাহলে তুমার পাছে লেগে আছি কেন তখন সে বলে, আমাদের আরো সময় নেওয়া উচিত এবং বোটানি গার্ডেন বা চিড়িয়াখানার মত জাগাগুলোয় হাত ধরা বা হাঁটতে হাঁটতে এক সময় গাছের আড়ালে গিয়ে জড়িয়ে ধরার মধ্যে খুশি থাকতে হবে আরো বহুদিন।
চতুর্থবার শাহেরার কলেজ শুরুর তৃতীয় দিনে তাকে আমি ধরে ফেলতে পারি এবং পঞ্চমবার তাকে পাই পরপর চারদিন দাঁড়িয়ে থাকার পর। তারও আড়াই মাস পরে সে আমাকে তার ক্লাসরুটিন দিলে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তার দরজায় ধরনা দিয়ে, যুগ যুগ ধরে (?) তার পথের দিকে চেয়ে থেকে আমি ঠিক কী চেয়েছি। শাহেরা ও ডানার মধ্যে ডজনখানেক সম্পর্ক ও পার্থক্যবাক্য রচনা করি মনে মনে কিন্তু তুলনা ও আলোচনা করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
প্রথম দিকে এবং বেশির ভাগ সময়ই শাহেরা নীরব থাকলে আমি ভাবি, আমার ভেতর বোধহয় কোনো আবেদন নেই কিন্তু পরের দিকে এবং অনেকবারই শাহেরা হাসিমুখে কথা বললে আমি ভাবতে শুরু করি, এবার হবে। এবার মানে কোনবার এবং কবে নাগাদ হবে তা নিয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠলেও ঢাকা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার আলম ভাইয়ের পরামর্শটা মেনে নিই চোখ বুজে। সঠিক সময়টির অপেক্ষায় থাক, তার প্রতি আরো আগ্রহ দেখাও, তার সম্পর্কে জেনে নাও সব খুঁটিনাটি, তবে কোনটি তার ব্যক্তিগত বিষয় সেটা ভাল করে বুঝতে হবে যেন সেখানে হস্তক্ষেপ না হয় এবং সর্বোপরি নিজেকে উপযুক্ত কর তার জন্য।
আমাকে উপযুক্ত হতে হবে।
ধানফুল মার্কেটিংয়ে চাকরি হবার পর আমি আরো আশাবাদী এবং ধৈর্যশীল হয়ে উঠি আর আমার স্পিরিট যেন একেবারে সপ্তমে, আমি সময়-অসময় চলে যাই তার খোঁজে, কখনও তার বাসা কখনও তার কলেজ। তবে আমি যখন অধৈর্য হই তখন শাহেরা কিঞ্চিৎ নরম হয় এবং দুপুরে লাঞ্চ করতে যাই কাঁটাবনের চিংড়িতে। পোলাউয়ের সাথে চিংড়ি ভুনা আর ইলিশ ও পটল ভাজা দিয়ে লাঞ্চ করার সময় আমার নজর থাকে প্রধানত তার টসটসে আঙ্গুলের দিকে আর মাঝে মাঝে বুকের দিকে। এই আঙ্গুল থেকে খাবার মুখে নেবার লোভ আমি কিছুতেই সামলাতে পারি না আর ওই বুকে মাথা রাখার লোভও বাড়তে থাকে ক্রমোর্ধ্বগতিতে যা আরো বাড়ে তার আঙ্গুল থেকে খাবার মুখে নেবার পর আঙ্গুলটাও মুখে পুরে নিতে নিতে। এসময় তার হাতটা মাঝে মাঝেই সঙ্গমরত সাপের মত মোড়ামুড়ি করলে আমি সেটা কোমল হাতে ধরে রাখি, ধরে রাখতে ইচ্ছে করে অনন্তকাল| ধরে রেখেই আমি তার বুক ও গলার দিকে চাই যা আমাকে আরো বিচলিত করে। এক সময় বলতে শুরু করি, আমি ওই বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই। অনন্তকাল। সে তখন মিটিমিটি হাসে আর বলে, এত কিছু দেখ কেন, যার উত্তরে আমি প্রথম দিকে তার মতই মিটিমিটি হাসলেও এক সময় বলতে শুরু করি, চোখ দেখে, আমি কি আর দেখি। তারপর সে আমার কাছে জানতে চায়, ছেলেরা সবাই এসব দেখে কেন এবং সে বলতে শুরু করে পাড়ার বখাটে ছেলেরা তাকে কতটা অতিষ্ঠ করে তুলেছিল যেকারণে ছেলেদের সাথে সে কথা বলাই বন্ধ রেখেছিল অনেক দিন এবং একারণে সে আমার সাথে মিশতে চায়নি প্রথম দিকে কিন্তু পরে সে আমাকে অন্য রকম ভেবেছিল।
আমি যখন জানতে চাই সে আমাকে কী রকম ভেবেছিলে তখন সে শুধু অন্য রকমই বলে আর এই অন্য রকমটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
আমি আবার আমার বন্ধু ও আলম ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইলে তারা বিজ্ঞের মত বলতে লাগল, মেয়েরা এরকমই বলে, তারা প্রেম করতে চায়, জড়িয়ে ধরে শুতে আপত্তি করে না, কিন্তু করতে গেলেই না না করে। এসব নিতান্তই কথার কথামাত্র।
এসবে কান না দিয়ে আমাকে তারা রোমাণ্টিক হবার পরামর্শ দিল।
তারা এও বলল, মেয়েরা চায় ছেলেরা তাদের অকৃত্রিমভাবে এবং ব্যক্তিত্বহীনভাবে ভক্তি করুক, যা আমি ভালই পারি বলে তাদের ধারণা। বন্ধুদের এসব মন্তব্য আমার একটুও ভাল না লাগলেও শাহেরার প্রতি আমি অকৃত্রিম ভক্তি দেখাতে সচেষ্ট থাকি যার নিদর্শন হিসেবে নিউমার্কেটের ফুলের দোকানে আমার যাতায়াত বেড়ে যায়।
দৈনিক সকালে নিউমার্কেট থেকে বাসে শুক্রাবাদ, বাস থেকে নেমে রিকশায় ময়লার ভাঁগাড়ের মত রাজাবাজারের মসজিদের গলিতে একশ একুশ নম্বর বাড়িটার গেটের সামনে হাজির হই যেখানে ঠিক সাড়ে সাতটায় এসে দাঁড়াবে শাহেরা। আমি প্রায়ই দশবিশ মিনিট আগে পৌঁছাই এবং পূতিগন্ধময় গলিতে খাড়া হয়ে অথবা মালেকের চায়ের দোকানে বসে সিগারেট টেনে সময় কাটাই। এটা আমি করতেই পারি কিন্তু শাহেরা গেটের সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। তবু তার মা-বাপ ও ভাই মাঝে মাঝেই দেখে সে বেরোচ্ছে অথবা ঢুকছে এবং দুএকদিন তারা জিজ্ঞেসও করেছে শাহেরা কোথায় গেছিল, সেটা কথার কথাইবা হোক না কেন।
তখন তুমি কী বল?
শাহেরা দোতালায় তার ফুপুর বাসায় পত্রিকা দেখতে গেছিল বলে জানায়, বলতে বলতে হেসে খুন।
দারুণ বুদ্ধি তো—!
আমি গোলাপটা তার হাতে দিই দুহাতে করে কিন্তু সে নেয় একহাতে। আমি একদিন তুমি কেন দুহাত বাড়াও না বললে সেও মৃদু হেসে দুহাত বাড়ায় এবং পরদিন থেকে দৈনিকই।
প্রথম দিকে আমি তাকে একটা করে গোলাপ দিতাম কিন্তু কিছুদিন পরে দুটি করে। প্রথম যেদিন দুটি দিলাম সে যেন আরো খুশি হল এবং আজ দুটি কেন জিজ্ঞেস করলে বললাম, একটা তুমার জন্য আরেকটা আমার জন্য কিন্তু আমারটাও তুমাকে দিলাম। সে তখন আরো খুশি হয়ে দৈনিক শুধু তুমিই দাও, আমি ত কিছু দিতে পারিনে বলতে বলতে কিঞ্চিৎ মনখারাপ করলে আমি অনুভব করি আমিও পেতে চাই কিন্তু হেসে বলি, তুমার দেওয়া লাগবে না। তখন সে নিষ্পাপ মধুর হাসি হেসে বলে, কাল থেকে দৈনিক সন্ধ্যায় আমি তুমাকে মনে মনে দেব আর তুমি মনে মনে নিয়ে নিয়ো।
দারুণ রোমান্টিক হবে, তাই না? আমি স্বতঃস্ফূর্ত হেসে বললাম, যদিও আমার মোটেও ভাল লাগেনি।
আমি নতুন করে ধৈর্যসাধনা শুরু করলাম কিন্তু কদিন পরেই শাহেরা বলল, তুমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে।
আমি অন্তত একযুগ ধৈর্য ধরে আছি। আর পারছি না। অথচ শাহেরাকে এটা ব্যাখ্যা করলেও বুঝতে চায় না অথবা বুঝতে পারে না। আমি তাকে বলার জন্য তৈরি হই আমি তাকে এখনই চাই, আমি তাকে বলতে চাই, তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার সবকিছু তছনছ হয়ে যায় কিন্তু আমি তা বলতে পারি না, কারণ আমি জানি সে বলবে, তুমার ধৈর্য নেই যা সে ইতিমধ্যেই খানিকটা বলেছে।
ত বু। ডানা আমার হাতের কাছে ভরা কলসির মত থাকার পরও পিপাসা মিটাতে পারি না। আমি কি ডানার কাছে ফিরে যাব। আমি গেলেই বেকুব যুবকটা বাতিল হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।
কি ন তু। আমার নড়তে ইচ্ছে করছে না। আমার বরং পেশাদার যুবতীদের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে।
খানিকটা নির্লিপ্তের মত, খানিকটা আলস্যে সময় কাটছে। যথাসময়ের অপেক্ষায় থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ কিন্তু গন্তব্য চিনতে পারাও ত বুদ্ধিমানের কাজ।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে রাখি। শাহেরা তা টের পেয়ে জানতে চায় আমার বন্ধুরা কী করে। আমি তাকে বলেছিলাম, তারা কেবলই হাহুতাশ করে আর আমি তাদের সামনে চুপ থাকি বলে তারা আমাকে ভেজা বেড়াল বলে, মিনমিনে বলে এবং আরো বলে, যা আমি শাহেরাকে বলি না, শালা একটা ডুবে ডুবে জল খাওয়া মাল। তারা এও বলে, কী ভয়ানক চিজ রে বাবা, দুই দুইটা মাল একসাথে খেয়ে যাচ্ছে। আর। শাহেরা বলে, আমাকে তার ভয় লাগে।
আমাকে তার ভয় লাগে! আমি আকাশ থেকে পড়ি। হতাশায় মুষড়ে যাই।
সেই শাহেরা একদিন যেন হঠাৎ করেই পুরোপুরি আমার হয়ে গেল। তারপর মাঝে মাঝেই, সম্ভবত তার যখন মন ভাল থাকে, আমার কাছে জানতে চায় বিয়ের পর আমি তার জন্য কী করব। একটা চাহিদা-তালিকাও সে সব সময় মুখস্থ করে রাখে। আমি যখন বলি আমি তার চুল বেঁধে দেব তখন সে জানতে চায় আর কী করব। আর-কী আর-কী করতে করতে অনেক কিছু বলার পর সুযোগ বুঝে যখন বলি, আমি তার কাচুলি বেঁধে দেব তখন সে আমার নাক টেনে আদর করে দেয়, যার ফলে আমি বুঝতে পারি এমন দুষ্টুমি করাই যায় আর সে তার চাহিদা-তালিকার সব কটিতে টিকচিহ্ন না পড়া পর্যন্ত প্রশ্ন করতেই থাকে। আমিও একে একে তার চুলে ফুল গুঁজে দেব, কবিতা পড়ে শুনাব ইত্যাদি রোমান্টিক পর্ব শেষ করে যখন বলি, আমি তার জন্য বাজার করে আনব, তার বাচ্চাদের ইশকুলে নিয়ে যাব তখন সে আরো খুশি হয় কিনা খেয়াল করি। সে খুব অল্পতেই খুশি হয় বলে মনে হয়েছিল, যেহেতু সে খুব শীগগীরই বলত, তাহলে সে কী করবে, যা আমার জন্য একটা দারুণ সুযোগ অনেক দিন পরে, কিন্তু আমি চট করেই বলি না যে তুমি আমার জন্য রান্না করবে, বরং টেকনিক করে বলি, তুমার হাতের রান্না পেলে আমি স্বর্গে চলে যাব এবং বুঝি যে রান্নার জন্য সে তৈরিই, যদিও বলে, ভালবাসার মানুষকে দিয়ে তুমি বুঝি রান্না করাতে চাও, এই হল তুমার ভালবাসার নমুনা, এ যে তার কৃত্রিম অনুযোগ তা মনে হয় সে যখন আগের মত আর গুরুতর ভঙ্গিতে না, বরং ফুরফুর করেই বলে, তুমার সবই ঠিক আছে, আমার ভাল লাগে কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এমন করে উদাসীন হয়ে পড় কেন, আত্মভোলা হয়ে পড় কেন তা বুঝি না এবং আরো ফুরফুর করে কবিতা লেখ নাকি বলতে বলতে গভীর কৌতুকে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। আমিও নিজের মধ্যে উদাসীনতা অনুভব করি কবিতার কানের দুল নেচে ওঠে বলে নাকি ঢাকায় আমি আর তিষ্ঠাতে পারছি না বলে তা আর বুঝতে পারি না।
শাহেরা ফুরফুর করে উঠে আমার গাল টেনে লাল করে দিল। কিন্তু মিনিট যেতে না যেতেই বলল, তুমার ভিতরে কোথায় যেন গুরুতর কোনো সংকট আছে যা অন্তত আমাকে তুমার বলা উচিত বলে আমি মনে করি, কেননা আমাকে তুমি তা না বলা মানে হল আমাকে তুমি পুরোপুরি আপন ভাব না। খুবই যুক্তিসংগত বলে তাকে এটা বলতে হবে, কিন্তু এটা আসলে কী তা কি আমি নিজেও ঠিক ঠিক জানি। নিজেকে প্রশ্ন করি আর উত্তর খুঁজি, তবে এসব যে শাহেরার কাছে খুব গৌণ বিষয় ছিল তাও শেষ পর্যন্ত বুঝলাম যখন সে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। অথচ তাকে আজ শাড়ি পরা কানের দুলে দেখেই আমার পা টলে উঠল, চোখমুখ শুকিয়ে গেল অথচ শাহেরা আজ এতটাই ফুরফুরে, সে যেন তা দেখতেই পেল না, বরং হাসিমুখে বাড়িয়ে ধরল হাতের গোলাপ-তোড়াটা। তার মুখেও মনোহর মধুর হাসি যা আমি আগে কখনও দেখিনি আর তার কণ্ঠও আজ কী মধুর!
তুমি আমাকে একটা করে ফুল দাও আর আমি তুমাকে দিলাম একতোড়া, ত্রিশটা না, পুরোপুরি একশটা। আমার ত্রিশতম জন্মদিনে।
অর্ধযুগ অপেক্ষার পর আমার তাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে জড়িয়ে ধরার কথা অথচ তার সাথে আমার কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে করল না, বরং চোখের সামনে ভাসল কবিতার কানের দুল কিন্তু শাহেরা যখন বলল, কী ব্যাপার, মন খারাপ নাকি, তখন আমাকে বলতেই হল, না না, মন খারাপ হবে কেন। ছল করে বলতে চাইলাম, সত্যিই তুমাকে পেয়ে গেছি দেখে কান্না পাচ্ছে, কিন্তু তা আর বলা হল না, এমনকি আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম, মুখে কোনো কথাই সরল না। তবে শাহেরা ভাবে আমি মান করেছি, যদিও তার কোনো কারণ নেই, তবু সে আমার মান ভাঙাতে মন দেয়, ছয় বছর ধরে ঘোরাচ্ছে বলে মান করেছি কিনা জিজ্ঞেস করে, যখন তার মুখে সেই মধুর হাসিটি লেগেই থাকে, অথচ শেষ পর্যন্ত তাকে গোলাপ-তোড়া হাতে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যেতে দেখলাম আর আমি হাঁ করে তার পথের দিকে চেয়ে, যেহেতু আমি এখন তাকে না, দেখছি শুধু কবিতার কানের দুল দুলছে অবিরাম আর আমার মনে পড়ছে, শাহেরা বলছে, তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে চেয়েছিলে।
আমি ত বহুবারই বলেছি, আমি শুধু তার জন্যই ঢাকায় আছি। নয়ত এই ডিজেলপোড়া ধোঁয়ামাখা ধুলোঢাকা ঢাকায় গাড়িঢাকা রাস্তায় আমি কেন আছি।
তুমি হয়ত ডানার কথা ভাবছ।
—0—