টাকা পড়ে টাপুর টুপুর

তারেক খান


‘নদে এল জল রে, জলদি করে চল!’ উৎসাহে টইটম্বুর সিরাজুর রহমান। পাজামার রিবনে গিরে দিল স্যান্ডো গেনজির ওপর দিয়ে। তারপর অমল-ধবল পাঞ্জাবিটা মাথার ওপর দিয়ে গলাতে গলাতে আবার গেয়ে উঠল, ‘ওরে জলদি করে চল রে, জলদি করে চল!’
আপন মনে হেসে ওঠে আছিরন নিসা। তারও মনের মধ্যে টগবগ করে ফোটে তরল সুখ। বায়বীয় হবার আগ পর্যন্ত। ‘এই নাও!’ নিজে একটা পান মুখে পুরে আরেকটা বাড়িয়ে ধরে আছিরন নিসা।
‘দেরি হয়ে গেল, ও খালুজান, শিগগির আসেন।’ রাসেলের কণ্ঠ ভেসে আসছে বাইরে থেকে, ‘মার্কেট চালু হবার সাথে সাথে জানাশোনা দরকার কীদেকী ভাবসাব।’
‘হঅ, চল যাই।’ পান নিয়ে পা বাড়ায় কাঁচাপাকা দাড়িমুখ সিরাজুর রহমান। সামনের দিকে হাঁটে আর পেছনে আছিরনের উদ্দেশে বলে, ‘আমি তাহলে গেলাম।’
‘হঅ, যাও আললার নাম নিয়ে।’
আছিরনসহ তাদের তিন কন্যে দরজায় দাঁড়িয়ে ফুরফুর করে বিদায় জানাল।
মনে মনে আললার নাম নিতে নিতে হাঁটে রাসেল-সিরাজ। সরুপথটা পার হয়ে গলিতে ঢুকতেই ডুবে যায় ধুলোর মধ্যে। জোরে হাঁটা শুরু করে নিজেদের অজানতেই।
এক মিনিট হাঁটলে বড় রাস্তা। ছয় লেনের রাস্তায় পিঁপড়ার সারির মত বাস-ট্যাক্সি-স্কুটার গাদি গাদি। ‘গাড়িঘোড়া সব দাঁড়ায় রইছে ক্যা?’ ফুরফুর করে বলে সিরাজুর রহমান, যদিও কারণটা সে জানে, ‘এত বেশি গাড়িঘোড়া হলে যা হয়।’
ধুলো আর ধোঁয়ার মধ্যে সাঁতার কাটে অন্যদের মতই। রাস্তা পার হয়ে মোড়ে গিয়ে রিকশায় উঠল। ‘খালুজান, গত সপ্তায় যেগুলো কিনেছিলাম সেগুলো আজ বেচে ফেলবেন নাকি তা তো কিছু ঠিক করলেন না? কি করবেন?’
‘তাই তো ভাবতিছি। আজ বেচলে কত লাভ হবেনে?’
‘গতকাল তো দেখলাম যে নব্বই হাজার লাভ হয়ে গেছে।’
‘তাহলে আর কয়দিন দেখা ভাল না?’
‘তা অবশ্য দেখা যায়। দাম তো হুহু করে বাড়ছে।’
‘কই নামবেন?’ রিকশাঅলা জিগায়।
‘আর একটু সামনে যাও। রাঙ্গা ভবনের সামনে।’
রাঙ্গা ভবনের সামনে গিয়ে রিকশা থামে। রাস্তার অর্ধেকজুড়ে চা-সিগারেটের দোকানে পুঁজিবাজারিদের ভিড় লেগে গেছে। হাটের মত। তা এটা তো একটা হাটই। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটায় সিরাজুর রহমান। লিফট দিয়ে আটতালায় উঠলেই সাবলাইম সিকুরিটিজ লিমিটেড।
পুঁজিবাজারিদের ভিড়ে গিজগিজ করছে বিশাল ঘরটা। একটু পরপর একেকটা টেবিলে কম্পিউটার সামনে একেকজন ট্রেড অপারেটর আর তার সামনে একেক দল পুঁজিবাজারি। ‘বেটেক্স দেখেন তো।’ বলল একজন।
‘বায়ার নব্বই টাকা, সেলার একানব্বই,’ বলল ট্রেড অপারেটর।
‘নব্বই টাকায় বাই দেন বার হাজার। ১৬৫৫ কোড।’
‘একানব্বইতে ডাইরেক্ট নিয়ে নেন। আজ ছিয়ানব্বই ছাড়ায় যাবেনে।’ একজন আরেকজনকে পরামর্শ দিল।
‘নেন তাহলে।’ পরামর্শ গৃহীত।
‘ওকে, বট।’ ট্রেড অপারেটর।
‘একানব্বইতে সেল বসান সাত হাজার।’ রাসেল বলল সিরাজের সাথে পরামর্শের পর। ট্রেড অপারেটর সেল অর্ডার সাবমিটের পর সিরাজের বুকের ভেতর খোঁচা মারে, ‘আমার মনে হচ্ছে কাল একশ ছাড়ায় যাবেনে।’
‘ক্যানসেল করে দেব?’
‘দে।’
‘১৬৭১ কোডের সেল অর্ডারটা—!’ রাসেল বলছিল, কিন্তু ‘ক্যানসেল করে দেন’ বলার আগেই ট্রেড অপারেটর বলে উঠল, ‘সোল্ড।’
সিরাজের মুখের দিকে চেয়ে লাজুক হাসে রাসেল মিয়া। সিরাজও হাসে। মৃদু হেসে হাত নাড়ায় এমন ভঙ্গিতে যার মানে যা হয়েছে ভালই হয়েছে।
‘হঅ, এবার আবার কম দামে যা আছে তাই কিনলেই তো হয়ে গেল।’
‘হঅ, তা ঠিক। এবার কোনটা কেনা যায়?’
‘সিঙ্গার নেবেন নাকি?’
‘কোনটার দাম বাড়ছে সেটা আগে দেখ।’
‘আমি একটু মার্কেট ঘুরে ভাবসাব দেখে আসি।’
‘হঅ, দেখ। আজ কত লাভ হল?’
‘এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মত হইছে।’
‘এক সপ্তায় পাঁচ লাখে এক লাখ ত্রিশ হাজার। এ তো টাকার খনি দেখছি রে।’
‘হঅ, কইছিলাম না আমি আপনারে? আপনি তো আমারে মোটে পাত্তাই দেন না। খালি কন যে ছিয়ানব্বইতে সবাই ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি খালি কই যে সে হল চোদ্দ বছর আগের কথা। চিরকাল কি আর সবকিছু এক রকম থাকে নাকি?’
‘হঅ, তা ঠিক। যুগ-জামানা সব পাল্টে যাচ্ছে। সেকালে দেখতাম যে মানুষ ব্যাগ ভরে ভরে কাগুজে শেয়ার নিয়ে আসত। আর এখন সব কম্পিউটারে বোতাম টিপলেই হয়ে যায়।’
‘চা নেন, সার।’ পিয়ন ট্রে-ভর্তি চা নিয়ে এল। সিরাজ এক কাপ চা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তুই যা তাহলে। দেখে আয় ভাবসাব কীদেকী। চা খাস তো খায়ে যা।’
রাসেল এক কাপ চা নিয়ে পা বাড়ায়। বিশাল ঘরটার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ায় আর অন্যদের আলোচনায় কান পাতে।
সিরাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেলফোন বের করে বাটন চাপে। খুশির খবরটা আছিরনকে না দিলেই নয়।
‘তাই নাকি?’ আছিরন যেন নাচন দিয়ে উঠল, ‘তাহলে ব্যাংকে টাকা থুয়ে লাভ কি? ছয় লাখ টাকায় ব্যাংক দেয় হল সারা মাস পরে ছয় হাজার।’
হঅ, সিরাজও তাই ভাবছে।
রাসেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ফিরে এল, ‘খালুজান, সিঙ্গারের দাম তো হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হঅ।’
‘কত করে এখন?’
‘৩১৫৪টাকা করে তো দেখে আসলাম।’
‘তাহলে নে শখানেক। কত করে চলছে?’
‘বাইয়ার ৩২৪২, সেলার ৩২৫২ টাকা।’
‘ওই দেখেন! প্রায় ১০০ বেড়ে গেল।’
সিরাজ কপালের চামড়া ভাঁজ করে চোখ উলটে তাকাল এবং বাড়তি দামেই নিয়ে নিল।
‘বেটেক্স কত করে?’
‘বাই ৯৪, সেল ৯৫।’
সিরাজের বুকের ভেতর ধড়াশ করে উঠল। হিসেব করে দেখল বেটেক্স এখন বেচলে কত বেশি লাভ হত। এই লোকসানে তার বুকের ভেতর ঢিবঢিব শুরু হয়। তবে সিঙ্গার বেড়ে ৩৩২২ টাকায় ক্লোজ হলে খানিকটা স্বাভাবিক।
দাম যখন কমে তখন ফুসফুসটা ফুস করে চিমটা লেগে যায় আর যখন বাড়ে তখন বেলুনের মত ফুলে ওঠে। পরপর তিনদিন বাড়ার পর এক সপ্তায় আরও এক লাখ লাভ হলে ব্যাংক থেকে নিয়ে বাকি ছয় লাখ বিনিয়োগ করল।
খবরের কাগজে শেয়ার নিউজ পড়তে শুরু করেছে সিরাজুর রহমান। মার্কেট দৈনিক চাঙ্গা হবার খবর। হাজার হাজার নতুন বিনিয়োগকারী আসার খবর। বিদেশি রেমিট্যান্সের টাকা, ঘুষের টাকা, পেনশনের টাকা, সব চলে আসছে শেয়ার বাজারে। কালো টাকা বিনিয়োগের দাবিতে বুদ্ধিজীবীদের আবদার পত্রিকা খুললেই। প্রায় দৈনিক একটা না একটা প্রাইভেট ব্যাংক, ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং কোম্পানি, বিমা প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব। সবাই বিনিয়োগ করছে শেয়ার বাজারে। কেউ যখন দুই শ পার্সেন্ট প্রফিট করে তখন অন্যরা আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না।
সিরাজুর রহমানের গা কাঁপতে লাগল তার নিজের পোর্টফোলিও দেখে। বিয়াল্লিশ দিনের ব্যবসায় তার এগার লাখ টাকার বিপরীতে লাভ দেখাচ্ছে ছয় লাখ দশ হাজার। নিজের চোখকেই যেন আর বিশ্বাস হচ্ছে না। সারা জীবন চাকরির টাকায় শুধু অভাব আর অভাব। এবার সত্যি সত্যি বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ছেলেমেয়েরাও সচ্ছলতার আনন্দে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে। সিরাজুর রহমান দৈনিক বিকেলে বাসায় ফিরে তাদের আরও আশাবাদী, স্বপ্নবিভোর করে তোলে। রাসেল মিয়া ভাবছে একটা মটরসাইকেল আবদার করার সময় হয়েছে কিনা।
‘খালুজান, আজ কি কেনবেন?’
‘ভাল করে চিন্তা কর। আমরা প্রায় দেড় মাস ধরে মোটে ছয় লাখ দশ হাজার লাভ করলাম। আর ওই যে ফাইন্যান্স কোম্পানিটা দেখ, ইউনিক লিজিং না কি যেন নাম, মোটে এক সপ্তায় দাম হয়ে গেল ডবল।’
‘ইউনিক লিজিং নেবেন নাকি?’
‘ভাবতিছি।’
‘বিএসআর স্টিল নেন ছয়শ। ১৮৯০ কোড।’ বলল একজন।
‘আমার অ্যাকাউন্টটা কি চালু হয়েছে, ভাই?’
‘কোড নম্বর কত?’
‘১৮৯০।’
‘ওকে। চালু হয়ে গেছে।’
‘বিএসআর স্টিল বাই করেন পাঁচশ।’
‘ব্র্যাক ব্যাংক করেন বারশ। ১৬৭১ কোড।’ সিরাজুর রহমান।
‘চোদ্দশ বাইশে ডাইরেক্ট নিয়ে নেব নাকি চোদ্দশ দশে বাই অর্ডার দেব?’
‘ডাইরেক্ট নিয়ে নেন। যেভাবে দাম বাড়তিছে—! একটু পরে আবার না পনের শ হয়ে যায়—!’
‘ওকে, বট।’ ট্রেড অপারেটর, ‘আপনি এগার লাখ টাকা লোন নিতে পারবেন। এগার লাখ টাকায় কেনা যাবে আরও সাত-আট শ। নিয়ে নেব নাকি?’
সিরাজ হিসেব করে বলল, ‘সাড়ে সাতশ নেন।’
তিন কারবারি দোড়োতে দোড়োতে এসে হাঁপাতে লাগল। আর তাদের সব শেয়ার বেচতে বলল :
‘ব্র্যাক ব্যাংক সেল দেন দশ হাজার। ৩০ কোড।’
‘চোদ্দশ পাঁচে ডাইরেক্ট দিয়ে দেব?’
‘দেন।’
‘ব্র্যাক ব্যাংক সেল দেন আট হাজার। ডাইরেক্ট। ১১ কোড।’
‘বিএসআর স্টিল সেল দেন দশ হাজার। ১৪ কোড।’
সিরাজ হাঁ করে দেখছে আর ভাবছে। আস্তে আস্তে তার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চোখের মণিদুটো স্থির অনড় মার্বেলের মত পড়ে আছে মনিটরের দিকে। অন্য অনেকের মত।
‘খালুজান, কিছু কিনেছেন নাকি?’ রাসেল এসে দাঁড়াল।
‘ব্র্যাক ব্যাংক কত করে চলছে?’ খালুজান।
‘তেরশ নয়, তেরশ তের।’ অপারেটর।
‘দাম অত কমে যাচ্ছে ক্যা রে?’ খালুজান।
‘কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিছু কিনেছেন নাকি?’
‘চল, চা খায়ে আসি।’
লিফট দিয়ে নিচে নামে তারা। বাস ট্রাক কার ট্যাক্সির জ্যাম লেগে আছে দেশের ব্যস্ততম শহর মতিঝিলে। ফুটপাতে চা-সিগারেট আর পিঁয়াজো-পাকোড়ার দোকানে পুঁজিবাজারিরা চায়ের কাপে আর সিগারেটের ধোঁয়ায় আলোচনায় মশগুল। সেসব আলোচনায় কান পাতে সিরাজুর রহমান। চা খেতে খেতে বোঝার চেষ্টা করে কে কি বলে। আজ সবার মুখে মোটামুটি কমন কথা, কয়দিন বেড়েছে, আজ খানিক কমবে।
‘হঅ, কমা-বাড়া তো শেয়ার বাজারে হয়ই।’
‘খালুজান, চলেন অন্যান্য হাউজে একটু ঢুঁ মারি। তাহলে বোঝা যাবে কিদেকি ভাবসাব।’
‘তা ভাল। চল যাই।’
লাইম লাইট ব্রোকার হাউজে ঢুকল তারা।
‘ব্র্যাক ব্যাংক কত করে চলছে?’
‘বারশ দশ, বাঁয় হল্ট।’ ট্রেড অপারেটর।
‘বারশ দশ?’ সিরাজের ঠোঁট কেঁপে উঠল, ‘আর বাঁয় হল্ট মানে কি?’
রাসেল মনিটরের দিকে তাকিয়ে। বাঁ কলাম যেখানে বাই অর্ডার থাকে সেটা একেবারে ফাঁকা। ডান কলাম যেখানে সেল অর্ডার থাকে সেখানে, রাসেল বলল, ‘সব সেলার বারশ দশে সেল অর্ডার দেছে, আজ আর বারশ দশের নিচে নামবে না, সার্কিট ব্রেকার আছে, কিন্তু বারশ দশেও কোনো বায়ার নেই, মানে বাঁয় হল্ট।’
‘মানে কি?’ সিরাজুর রহমান যেন বুঝেও বোঝে না। তার গলা কাঁপতে থাকে। কিন্তু রাসেল সহজ সুরেই বলে, ‘মানে কেউ ইচ্ছে করলেও এখন আর ব্র্যাকের শেয়ার বেচতে পারবে না। কারণ বায়ার নেই।’
‘তাহলে যারা কিনেছে তাদের কি হবে?’
সিরাজের হাতপা কাঁপতে লাগল। খেয়াল করে রাসেল বলল, ‘ওটা কোনো ব্যাপার না। শেয়ার বাজারে মাঝে মাঝেই এমন হয়। এখন যেমন কেনার লোক নেই, সবাই বেচতে চাইছে; একটু পরে হয়ত দেখা যাবে যে বেচার লোক নেই, সবাই কিনতে চাইছে।’ এটাই ঢাকার শেয়ার বাজার।
‘ওও!’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সিরাজুর রহমান। রাসেলের ওপর পুরোপুরি ভরসা না করে আরও কজনের সাথে কথা বলে স্বস্তি ফিরে পায়। কিন্তু মার্কেট বন্ধ হলে নিচে নামতে নামতে আবার দুশ্চিন্তা। বেশ গুঞ্জন চলছে, মার্কেট বোধহয় পড়ে যাচ্ছে।
বাসায় ফিরে টিভি ছেড়ে শেয়ার বাজার বিষয়ক খবরের অপেক্ষায় থাকে সিরাজুর রহমান; টেলিভিশনের খবর পাঠক ‘এবার শেয়ার বাজারের খবর’ বলার সাথে সাথে নড়েচড়ে বসে। ‘আজ একশ চল্লিশটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক পড়ে গেছে।’ টেলিভিশন বলছে, ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক এই পতন অস্বাভাবিক হলেও সত্য যে, প্রায় সব শেয়ারের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।’
‘সতর্কতা মানে কি?’ সিরাজ।
রাসেল চুপ। সে বরং ল্যাপটপ খুলে বসল। খানিক পরে বলল, ‘সতর্কতা মানে হল সব টাকা বিনিয়োগ না করা, বেশির ভাগ শেয়ার সেল করে দিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করা, ইত্যাদি।’
কদিন আগে একটা বই কিনে এনেছিল সিরাজুর রহমান। সেটা খুলে বসল। কোন শেয়ারে কখন বিনিয়োগ করতে হয় আর কখন বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হয়, কোন শেয়ারে বা কখন আদৌ বিনিয়োগ করা ঠিক না, কমপক্ষে কয়টা আইটেমে বিনিয়োগ করা উচিত, ইত্যাদি, বুঝতে বুঝতে সিরাজুর রহমানের মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। বইয়ের ভাষা মাথায় ঢুকছে। মাগরিবের নামাজ পড়ে দীর্ঘ মোনাজাতে আললার কাছে প্রার্থনা, আগামী দুই কার্যদিবস ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার ম্যাচিউরড না হওয়া পর্যন্ত দামটা যেন থির থাকে।
‘কি হইছে? কি নিয়ে এত দুশ্চিন্তা হচ্ছে সেই বিকেল ধরে?’ ফুরফুরে আছিরন।
‘না, কিছু না।’
আছিরনও আর ভাবে না।
ছেলেমেয়েরা নানা আবদার নিয়ে হাজির হল। কেউ আগামী মাসেই এই ঘিঞ্জি গলি থেকে ভাল কোনো এলাকায় বড় বাসায় উঠতে চায়, কেউ চায় স্যামসাং গ্যালাক্সি, কেউবা আইপ্যাড, ইত্যাদি
সিরাজুর রহমান ফুরফুরে হতে চেষ্টা করে। লোকসান হলেও কতই বা হবে। যা লাভ হয়েছে তা থেকেই না হয় কিছু যাবে। এরপর বুঝেসুঝে কিনলেই হয়।
এবার তাহলে বইটা পড়া যাক।
গভীর মনোযোগে ইপিএস, পি/ই রেশিও ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিরাজুর রহমান।
পরদিন সকালে আবার দৈনিকের মত অমল-ধবল পাঞ্জাবি-পাজামা গায় চড়িয়ে পান চিবাতে চিবাতে রওনা হয়। মনের মধ্যে পূর্ণ সাহস।
কি আশ্চর্য! আজ দশটা বাজতেই লোক গিজগিজ করছে মতিঝিল শেয়ারপাড়ায়। কেন? এখানে কি ঠাডা পড়েছে নাকি যে মার্কেট খুলবে সাড়ে দশটায় অথচ প্রায় সবাই দশটায় এসে পড়ল? তারপর তারা অবাক হয়ে দেখতে লাগল, বেশির ভাগ ব্যবসায়ী শুধু সেল করছে।
‘বিএসআর সেল দেন দশ হাজার।’
‘বায়ার নেই। বাঁয় হল্ট।’ ট্রেড অপারেটর।
‘ওরিয়ন সেল দেন ত্রিশ হাজার।’
‘বায়ার নেই। বাঁয় হল্ট।’ ট্রেড অপারেটর।
‘বেটেক্স সেল দেন বিশ হাজার। ‘এবি ব্যাংক সেল দেন চোদ্দ হাজার। ‘এনবিএল সেল দেন তেইশ হাজার। ‘স্কয়ার সেল দেন বার হাজার।’
একের পর এক শুধু সেল অর্ডার আর ট্রেড অপারেটর ‘বায়ার নেই, বাঁয় হল্ট’ বলতে বলতে কাহিল।
বেশির ভাগ শেয়ারেরই ক্রেতা নেই। বারটা বাজতে বাজতে সব শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ল।
সিরাজুর রহমান গত তিনদিন মার্কেটে যাচ্ছে না। সে নিজে যেমন কিনছে না তেমনি অন্যরাও তো কিনবে না, ভাবতে ভাবতে তার হাতপা পেটের ভেতর সেধিয়ে যাচ্ছে। তবে তিনদিন পর ফোন রিসিভ করে সে অবাক।
‘বায়ার আসছে!’ খবরটা তাকে সাবলাইম সিকুরিটিজ হাউজ থেকে ফোন করে জানাল। সিরাজ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘ব্র্যাক ব্যাংক কত করে চলছে?’
‘৬৮০ টাকা।’
অষ্টম কার্যদিবসে গিয়ে বায়ার আসে, যখন সব শেয়ারের দাম অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে ব্র্যাক ব্যাংকের মতই।
শোনার পর ঝিম ধরা মাথায় হিসেব কষে সিরাজুর রহমান, ৬৮০ টাকা হারে তার ১২০০ শেয়ারের দাম ৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা। লোকসান তিন লাখের কম। অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আললা রক্ষা করেছে। কিন্তু রিকশায় উঠে পোর্টফোলিও খুলে দেখল, তার আছে ১৯৫০টি শেয়ার। তার কানের মধ্যে ঝনাৎ করে বেজে ওঠে, ট্রেড অপারেটর বলছে, ‘আপনি এগার লাখ টাকা লোন নিতে পারবেন। এগার লাখ টাকায় কেনা যাবে আরও সাত-আটশ। নিয়ে নেব নাকি?’
‘সাড়ে সাতশ নেন।’ সিরাজ বলেছিল। বিষয়টা সে এখন বুঝেও বুঝল না কিন্তু তার বুকের ভেতর টিপটিপ করতে লাগল। টিপটিপ বুকেই সিকুরিটিজ হাউজে প্রবেশ। সাথে রাসেল।
‘আপনি তো সিরাজুর রহমান, তাই না?’
‘জি।’
‘আমার সাথে আসেন।’
পিয়নের সাথে গিয়ে ব্যবস্থাপকের কামরায় ঢুকল সিরাজুর রহমান।
‘সার, আমি দুঃখিত যে আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিচ্ছি। সব শেয়ারের দাম আরও পড়ে যেতে পারে। আপনার শেয়ারগুলো এখনই বেচে ফেলা উত্তম!’ বিজ্ঞের মত বলল ব্যবস্থাপক। যদিও সকালে বায়ার আসার সাথে সাথে সিরাজের ১৯৫০টি শেয়ার বেচে ফেলেছে।
‘দাম আর বাড়বে না?’
‘আপাতত আর বাড়বে না বলে ধারণা করছি। এখন বরং আরও অনেকখানি কমতে পারে।’
‘আরও কমবে?’ সিরাজের চোখ কপালে ওঠে; কিন্তু ব্যবস্থাপক সেল-অর্ডার ফর্ম বাড়িয়ে ধরলে নিচে নামিয়ে সই করতে হয়।
ফর্মটা নিয়ে পা বাড়ায় ব্যবস্থাপক। তারপর ট্রেড অপারেটরের টেবিল থেকে ঘুরে এসে একটা ট্র্যান্সক্রিপশন এগিয়ে দিল। ১৯৫০টি শেয়ার ৬৮০ টাকা দরে ১৩ লাখ ২৬ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। সেখান থেকে সাবলাইম সিকুরিটিজ কেটে নিচ্ছে তার ১১ লাখ প্লাস সুদ—।  
তাহলে আর থাকছে—।
সিরাজুর রহমানের মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠল। চোখের সামনে শরষে ফুল। তবে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ার আগেই ব্যবস্থাপক ও রাসেল তাকে ধরে সামলায়। তারপর ধুলোর মধ্যে সাঁতার কাটতে কাটতে ঘিঞ্জি গলি দিয়ে এগিয়ে গেলে বাসা।
ধুলোর সাগরে এসি প্রাইভেট কারে ডুবোজাহাজের মত চলার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। অভাবের মধ্যে বার্ধক্যজনিত মৃত্যু এগিয়ে আসছে গুটিগুটি পায়।
[প্রথম প্রকাশ, প্রান্তস্বর, ২০১৪]

—০—