তারেক খান
রায়গাঁও ফুফুবাড়ি থেকে বের হলেই গেঁয়োপথ। তারপর
মেঠোপথ, খালবিল, সাঁকো আর গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিয়ে আমি ছুটছি অবিরাম, অক্লান্ত।
পায়ে পায়ে চার ঘণ্টা চলার পর রয়না বিলে
গিয়ে দূর থেকেই দেখা যায় আমাদের শিমুলগাঁও। সাথে সাথে বুকের ভিতর হুহু করে উঠল। আরো
দুই ঘণ্টা বিল ভাঙার পর গ্রামে ঢোকার পথে ছনখেত ভরা তালগাছ, তালগাছ ভরা বাবুই পাখির
বাসা দেখি না কত কাল। আকাশে আগুন ধরানো কৃষ্ণচূড়া অথবা সেই বুড়ো বটের অবাক জটাজুট ঘেরা
মন্দির, শিমুল জারুল সারেবেসারে। কত দিন দেখি না—! সেকি মোটে তিন দিন।
যতবার কুটুমবাড়ি থেকে ফিরি ততবার কেন এমন
হয়। ওরা আমাকে না পেয়ে মন খারাপ করে? ওরা আমার পথের দিকে চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে?
আর মন খারাপ করে না, শিমুলগাঁও, এই যে আমি
ফিরে এসেছি। আমি এখানেই আমার মায়ের বুনোভূত হয়ে থেকে যাব চিরকাল। গ্রীষ্মের ধুলোঘাম,
বর্ষার কাদাপানি আমার নিত্যসাথি। যেমন ছিল অতীতে তেমনি থাকবে চিরকাল। আমি এখানেই জিতেন
সারের শাখামৃগ হয়ে ঘুরে বেড়াব সকাল সন্ধে দুপুর বিকেল। ফুফুবাড়ি গিয়ে আমার মানুষ হবার
বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমি তার হনুমানটি হয়েই থাকতে চাই।
শুকুর আলি, এমন করে মিথ্যে বলে না, কেমন?
কই মিথ্যে বললাম?
একটু পরেই বুঝতে পারবে যখন খালেক মাশটেরের
বাড়িটা পার হয়ে বাঁশবনের পথ ধরবে, কবরস্থান পার হবার সময় যখন কবিতা এসে পথ আগলাবে,
কানের দুল দুলিয়ে বলতে থাকবে, তুমি আর আমার দিকে তেমনি করে তাকাও না কেন, শুকুর আলি?
বলবে অবিরাম, অক্লান্ত। বলবে অনন্ত কাল।
আমাকে যেন সে পাগল করে ফেলতে চায়। আমি এখন
কী করব।
ক্ষমা কর শিমুলগাঁও। বিদায় শিমুলগাঁও। আমাকে
এখনই ছুটতে হবে।
আমি আবার রায়গাঁও ফুফুবাড়ি।
বড় ফুফু আমাকে মানুষ করার সুযোগ পেয়ে খুশিতে
ডগমগ যা সে বহুদিন ধরে আশা করছিল। এখন থেকে সে আর আমাকে হনুমানটি থাকতে দেবে না। খবর
পেয়ে ছুটে আসছে হরু নাপিত। সহপাঠী ফুফাত সোহানা মিটিমিটি হাসছে। আমাকে মানুষ হতে দেখে?
কিন্তু রায়গাঁও থাকলে আমি নির্ঘাত মারা
পড়ব। শিমুলগাঁও আমার পথের দিকে চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমাকে ছাড়া সে বাঁচে কী
করে। ইদানীং তুমি আর শিমুল ফুলের মাইক বানাও না ক্যা, শুকুর আলি? বড় হয়ে গেছ বুঝি?
শিমুলগাঁওর পীড়িত কণ্ঠ আমি অবিরাম শুনতে
পাই। তার দুঃখ আমি কি সইতে পারি।
দুঃখ কর না শিমুলগাঁও। আমার ছেলেমেয়েরা
ঠিকই তুমার জন্য শিমুল ফুলের মাইক বানাবে।
তাই বলে তুমি আমাকে একা ফেলে চলে যাবে?
না না। আমি এখনই আসছি।
কি ব্যাপার, বারবার কেন ভুলে যাও, কবিতা
তুমাকে শিমুলগাঁও যেতে মানা করেছে। যখনই তুমি শিমুলগাঁও যাও তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়
আর অবিরাম অক্লান্ত কানের দুল দুলিয়ে বলতে থাকে, তুমি আর আমার দিকে তেমনি করে তাকাও
না কেন, শুকুর আলি?
—এসব দেড়যুগ আগের ঘটনা যখন আমি আট ক্লাসে
পড়তাম?
—এসব একযুগ আগের ঘটনা যখন আমি গ্রাম ছাড়লাম?
আমি তুমাকে ভুল বুঝেছিলাম কবিতা। তাই বারবার
তুমাকে ছেড়ে পালিয়ে যেতাম। কখনও ফুফুবাড়ি, কখনও কলেজ হোস্টেল, কখনও—।
আর শেষ পর্যন্ত তুমি সুদূর ঢাকায় চলে গেলে।
জান আমি কত কেঁদেছি?
আমি আবার ফিরে আসছি, কবিতা।
তুমি আবার আমার দিকে তেমনি করে তাকাবে ত—?
তুমি যা বলবে আমি তাই করব।
তুমি এখন কোথায়?
এইমাত্র আমার নাইট কোচ নড়ালে পৌঁছাল।
উঃমাঃ এখন ত রাত। চারটে বাজে। এত রাতে গাড়ি
চলে বুঝি?
চলে ত। সারা রাত গাড়ি চলে।
নড়াল থেকে শিমুলগাঁও ত অনেক দূর। এখন তুমি
আসবে কিবায়?
কুনু ব্যাপার লয়। একযুগ পরে কাঁচা রাস্তায়
হাঁটুসমান ধুলো মেখে হাঁটতে আমার দারুণ লাগবে। তুমার সাথে নিরিবিলি গপ্প করতে করতে
আরামসে চলে আসব।
এতদিন তুমি আমার সাথে কথা বল নাই কেন? জান,
আমার কত মন খারাপ হত? সব সময় শুধু—।
টুং টাং টুং—!
এ কী। এত রাতে গ্রামের রাস্তায় ভ্যান।
‘ঢাকার গাড়ি থামার শব্দ শুনে আগোয় আলাম
যে দেহি কিডা কুহানে যাবে—আগোয় দিয়াসি গে।’
আমিও যেন ঘোড়া দেখে খোড়া। ‘শিমুলগাঁও যাবেন?’
‘সে ত বহুত দূর।’
‘যাবেন?’
‘ওঠেন। আললার নাম নিয়ে রওনা দিই।’
‘এটা কোন গ্রাম, ভাই?’
‘এটা দাশু মোড়। ক্যা, আপনি চেনেন না?’
হঅ, আমি ত দাশু মোড়েই নামতে চেয়েছি। নাইট
কোচটা আমাকে দাশু মোড়েই নামিয়েছে কিন্তু আমি কিছু চিনতে পারছি না। ভ্যানটা একটু উত্তরে
এগিয়ে গেলে মোড়টা চেনা চেনা লাগে। এখান থেকে পুবদিকে একটাই রাস্তা। কাঁচা রাস্তা। ঘণ্টা
চারেক হাঁটলে আমাদের শিমুলগাঁও।
ভ্যানটা পুবদিকেই মোড় নিল বটে, এটা একটা
ছোট পাকা রাস্তা। আমি অপ্রস্তুত বোধ করি। ‘আপনি আমারে কুহান দে কুহানে নিয়ে যাচ্ছেন?’
‘এইডেই শিমুলগাঁর রাস্তা।’
‘আর কুনু রাস্তা নেই? কাঁচা রাস্তা?’
‘আর কুনু রাস্তা নেই। আট-নয় বছর আগে এই
রাস্তা পাকা হলি তহনতে আমরা এই রাস্তায়ই চলি। তার আগে ত ওদিকি মোটে যাতামই না।’
আট-নয় বছর—! আমার বুকের ভিতর ঢিবঢিব করে
উঠল। আমি ত ভাবছিলাম যে আট-নয় মিনিট বুঝি।
আকাশ একটু ফরসা হয়েছে কিন্তু আমি আশপাশ
তাকিয়ে কিছুই চিনতে পারি না। মাধ্যমিক পাশ দিলে আমার বাপ দারুণ খুশি হয়ে আমাকে যে নতুন
হিরো সাইকেলটা উপহার দিয়েছিল, আমি তাই নিয়ে হিরো হয়ে যে রাস্তায় ধুলোর ঝড় তুলে বেড়াতাম,
দৈনিক সকালে কলেজ ধরতাম, কবিতা যতদিন নিরিবিলি ঘুম দিত, এই কি সেই রাস্তা। দুপাশে সারি
সারি রেনট্রি, কড়ই ও মেহগনির রাজত্ব। কোথাও কোনো তাল তমাল শিমুল জারুল দেখিনে ত।
মাঝে মাঝে তুমি অমন করে খেপে যেতে কেন,
কবিতা? আমাকে একেবারে পাগল করে ফেলতে।
তুমি আর আমার দিকে তেমনি করে তাকাও না কেন,
শুকুর আলি?
‘এই রাস্তা কোন পর্যন্ত পাকা হইছে?’
‘শিমুলগাঁ হয়ে রায়গাঁ অবধি।’
কিন্তু শিমুলগাঁয়ের পুবে ত কোনো রাস্তাই
ছিল না। ছিল শুধু বিল। উত্তর, পুব ও দখিনে বিলঘেরা শিমুলগাঁও। বর্ষাকালে উপদ্বীপ হয়ে
বিলের ভিতর পিঠ ডুবিয়ে জেগে থাকত দিনরাত। চেয়ে চেয়ে দেখত ডুঙ্গায় চড়ে মাছ ধরার দৃশ্য।
দিনের বেলা ছেলেমেয়েরা আর রাতভর তরুণ-যুবারা হাঁড়ির ভিতর কুপি জ্বেলে ফুলকোচ কুপিয়ে
মাছ ধরে বেড়াত।
ভ্যানটা অনেকগুলো গ্রাম, দুইটা বিল ও গোটা
চারেক গ্রামীণ বাজার পার হয়ে একটা বিলের ধারে গিয়ে থামল।
‘এইডে শিমুলগাঁর শেষ মাথা। আপনি যাবেন কই?’
‘এইডে শিমুলগাঁর শেষ মাথা?’
‘হঅ।’
‘আর ওই যে বাজারডা দেহে আলাম?’
‘ওইডে শিমুলগাঁ বাজার। আপনি যাবেন কই?’
আমি কী কই। এই রাস্তাটা যেদিকে চলে গেছে,
পুবদিকে রায়গাঁও অবধি, আমি কি এদিকেই বিল পাড়ি দিয়ে ফুফুবাড়ি যেতাম? শুকনোয় হেঁটে,
বর্ষায় নৌকায়? কিন্তু শিমুলগাঁয়ের সেই শিমুল-জারুল কই। ছনখেত ভরা তালগাছ, তালগাছে বাবুই
পাখির বাসা, আকাশে আগুন ধরানো কৃষ্ণচূড়া অথবা সেই বুড়ো বটের অবাক জটাজুট ঘেরা মন্দির—সেসব
ত কিছুই দেখলাম না। পাকা রাস্তার দুপাশে কেবলই সারি সারি রেনট্রি, কড়ই ও মেহগনির রাজত্ব।
‘কী ভাবেন, ও ভাই? যাবেন কই?’
আমি কিবায় কই যাব কই। শুধু ভাবি শিমুলগাঁয়ের
সেই এবড়োখেবড়ো গেঁয়োপথটা কই। তার উপরই কি এই পাকা রাস্তাটা। আর পথে যে চকচকে একটা দালানে
দুর্গাপ্রতিমা দেখে এলাম সেটাই সেই দস্যুডাঙ্গার দস্যুনাশিনী দুর্গামন্দির? হিন্দুরীতির
যে নির্দিষ্ট স্থাপনাকে আমরা মণ্ডপ বলে জানতাম, তার বদলে—। আর সেই জটাজুটঅলা বুড়ো বট—?
আমাদের সেই দোচালা ইশকুলটাবা কই গেল।
পথে একটা বড় দোতালা ইশকুল দেখ নাই?
ওটাই কি—।
কিন্তু আশপাশে এত রেনট্রি, কড়াই, মেহগনি
কোত্থেকে এল। কেনইবা। শিমুলগাঁয় এসব কোনো দিন ছিল না ত। আর ওই বাজারটা যদি নতুন হয়ে
থাকে তাহলে বিলের ধারে শিমুলগাছতলায় ফুটু ঘোষের যে কাঠের তৈরি দোকানটা ছিল সেটা কই।
‘আমি কি চলে যাব নাকি, ও ভাই?’
ভ্যানে উঠে বাজারে গেলে প্রথম চেনা চেনা
লাগে একটা বড় পুকুরপাড়ে বরইগাছ। কিন্তু পুকুরের ওপাশে রসুল মিয়ার যে আটচালা ছনের ঘরটা
ছিল তা ত নেই। অবশ্য সে রকমই বড় এক আটচালা টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে। তাহলে—। পুকুরপাড়ে
এরকম বরইগাছ কি আরো অনেক গ্রামে দেখিনি। শিমুলগাঁয়ের পুকুরপাড়ে, বরইগাছের কাছে, রাস্তার
পাশে বিলের ধারে শিমুলগাছতলায় ছিল ফুটু ঘোষের কাঠের তৈরি মুদির দোকান। আর এখানে পুকুরপাড়ে
বরইগাছের পাশে দেখা যাচ্ছে চায়ের দোকান। রাস্তার ধারে কোনো বিলও নেই। গ্রামটা তাকে
ঠেঙাতে ঠেঙাতে আরো দখিনে নিয়ে গেছে? চায়ের দোকানে যে কিশোর ছেলেটাকে দেখছি—। নাহ্—।
আমি ওকে চিনি না। কিন্তু জিগানো ত যায়, ভাই আমাদের বাড়িটা কই? না না, আমাদের না। আমাদের
জাগায় আমার বাপ শেখ হাফিজ উদ্দিন।
‘কিডা, শুকুর ভাই না?’
আমার বুকের ভিতর ধড়াশ করে উঠল।
কিশোর ছেলেটা দোকান থেকে বের হয়ে আসছে।
‘আমারে চিনতি পারতিছেন না, ও ভাই? আমি ইমরান।’
আমার মুখে কথা সরে না। ইমরান নামে রসুল
মিয়ার এক বালক ছিল। এই হয়ত সেই।
‘ইহানে অ্যাটটা শিমুলগাছ ছিল না?’
‘ইহানে শিমুল গাছ থাকপে ক্যা?’
‘আর ফুটু ঘোষের মুদির দুকান?’
‘হঅ, ওইডা আগে এই জাগায় ছেলো। কিন্তু ইডা
ত আমাগে জাগা। তাই ফুটু ঘোষ ওইপাশে নিজিগে জাগায় চলে গেছে।’
‘ওই পাশে মানে কোন পাশে?’
খানিক পশ্চিমে রাস্তার দখিনে ইমরান একটা
লম্বা ছাদঅলা দোকানের দিকে তর্জনী তুলল। ‘ভাই ত গ্রামের কথা অ্যায়েবারে ভুলেই গেছেন।’
আমি মলিন হেসে ইমরানের দিকে তাকালাম। আমার
ত সব সময় মনে হত যে আমি গ্রামেই ছিলাম।
এতক্ষণে নিশ্চিত হই এই আমার সেই শিমুলগাঁও।
আমাদের বাড়ির অবস্থানটাও অনুমান করতে পারছি। প্রথমেই পশ্চিম দিকে হাঁটতে হবে। রাস্তার
দুপাশে দোকানিরা এসে ঘুম জড়ানো চোখে ঝাপ খুলছে। সার বিষ ডিজেল, কংক্রিটের খুঁটি, স্লাব,
ফার্মের মুরগি—। সব আমি যাওয়ার পর আমদানি হয়েছে।
শুধু এসব কেন, পুরো বাজারটাই ত।
ও, হ। আমি থাকলে আমি এদের ঠেকিয়ে দিতাম?
অনেকেই আমার দিকে তাকাচ্ছে। ‘কিডা, শ্যাখের
বিটা নাকি?’ অনেকেই কথা বলতে চায়। কিন্তু আমার বুকের ভিতর হুহু করে। এ আমি কোথায় এসেছি
যেখানে অনেকেই আমাকে চেনে অথচ আমি কিছুই চিনি না।
আমার স্বাস্থ্য-চেহারা তেমন পরিবর্তন হয়নি
বুঝতে পারি।
ফুটু ঘোষ দোকানের ঝাঁপ খুলছে। আশ্চর্য,
লোকটা এখনও যেন আগের মতই আছে। সেই ছোটখাটো হালকা পাতলা ফরসা।
‘কাকা, ভাল আছেন?’ আমার গলা ধরে আসছে।
ফুটু আমার দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ সময় নিল।
‘কিডা, আমাগে শুকুর না? হঅ, আছি ত ভাল। তা এতকাল পরে আমাগে কথা মনে পড়িছে বুঝি?’ এগিয়ে
এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখ থেকে টপটপ করে দুফোঁটা পানি ঝরল আমার পিঠের উপর। ‘তামান
দিন তুমার বাপরে কই যে ছায়ালডারে এটটু আসতি কও। কতদিন দেহিনে। তা তুমার বাপ অমনি মুখ
ব্যাজার করে থায়ে। কানতিও দেহি মাঝেমধ্যি। তা থাকপানে ত কয়দিন?’
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আমি ত
একেবারেই চলে এসেছি।
আরো পশ্চিমে রেনট্রি-কড়াই ঢাকা রাস্তা দিয়ে
আগাতে হবে। শিকদেরপাড়ার প্রথম বাড়িটা খালেক মাশটেরের। বড়সড় একটা জীর্ণ কাঠের ঘরসহ পুরো
বাড়ি জঙ্গলে ঢাকা। বড় ঘরটার উত্তর পাশে ছোট একটা ভেঙে পড়া টালির ঘরের পিছনে বড় একটা
আমগাছ। এখনও যেন আগের মতই আছে। গাছের ডালে কেউ গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে না। গাছের পাশেই
শিকদেরপাড়ার ছোট্ট কবরস্থান। এটাও ঘিরে দেওয়া হয়েছে। নতুন পাঁচিল টপকে এসে দাঁড়াল কবিতা।
কতকাল দেখি না তুমায়—।
আমাকে পাগল কর না, প্লিজ।
এতদিন কোথায় ছিলে?
ঘুম আসে না? ঘুম দাও।
চলে যাচ্ছ কেন? একটু দাঁড়াও না, প্লিজ।
না।
তাহলে একটু আস্তে হাঁটো।
তাও না।
লাল পিঁপড়ার ডিম খুঁজতে এসো কিন্তু।
লাল পিঁপড়ার ডিম কমপক্ষে একযুগ গভীরে ঘাই
দিলে আমি হঠাৎ ভূমিকম্পে টালমাটাল হয়ে যাই। তবে ডুকরে কেঁদে উঠতে গিয়ে দ্রুত সামলে
উঠলাম। লাল পিঁপড়ার ডিম মনে করিয়ে দিল, কোথাও ত একটা ডোবানালা দেখলাম না। এখন কি আর
কেউ বড়শি দিয়ে মাছ ধরে না।
কি ন তু।
আমি ভেবে পাচ্ছি না, শিকদেরপাড়ার পুবপাশ
দিয়ে যে গেঁয়োপথটা ধরে আমি বাড়ি যাব সেই পথটা কই। খালেক মাশটেরের বড় ঘরের পুবপাশ দিয়ে
উত্তরমুখী ছিল আঁকাবাঁকা একটা বুনোপথ যেটা যষ্টি মাস আসতে না আসতে অস্তিত্ব হারাত আর
অঘ্রান মাসে গরুর গাড়ি আবার তাকে আবিষ্কার করত। সেটাই কি এই ইট বিছানো রাস্তা? দুপাশের
সব বাড়ি তারকাঁটা আর সুপারির খোলা দিয়ে ঘেরা। একটা ইটের পাঁচিল ঘেরা বাড়িও দেখা যাচ্ছে।
এই ঘেরাঘিরির চাল কবে শুরু হল। কার কোন বাড়ি আমি কিছুই চিনতে পারছি না। এরা আমার কেউ
না? কারা এরা। এখানে—খালেক মাশটেরের বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে শিকদেরপাড়া আর পুবদিকে ঘন
জঙ্গল ছিল না? এখানে ত দেখছি শুধুই বাড়িঘর। আর সারাদিন অন্ধকার হয়ে থাকা সেই বাঁশবনটাইবা
কই গেল। বড় রাস্তা থেকে নামলেই যেটা দেখা যেত। একটা-দুইটা বাঁশ প্রায়ই পথ আগলাত। ডিঙিয়ে
গেলে লাফ দেয় যদি? আর নিচ দিয়ে হামাগুড়ি দিলে ঠেসে ধরে যদি? হঅ, রহিমকে ঠেসে ধরেছিল
শুনেছি ত। ছিরুকে ওপরে তুলে ছুড়ে ফেলেছিল তাও ত শুনেছি। এমনতর আরো শত গপ্প বুকে হিম
ধরিয়ে দিত না? এই পথে একা চলা কী যে বিপদ ছিল।
লাঠি ভর দিয়ে যে কুঁজো বুড়িটা আসছে এই কি
সেই হবির মা নাকি। আশ্চর্য এই বুড়ি। আমি সেই ছেলেবেলা থেকেই তাকে প্রায় এরকমই দেখে
আসছি। আমার গলাটা যেন আরো ব্যথা করছে।
‘কিডারে? আমাগে শুকুর না?’ বুড়ি গলা বাড়িয়ে
থুড়থুড় করছে। বুড়ির চোখ এখনও ভাল আছে?
‘হঅ, দাদি, ভাল আছেন?’
‘ওরে আমার সুনারে—তোর কথা দৈনিক শুনতি চাই
তোর মার কাছে। তা তোর মা খালি কান্দে।’
আমি কান্দি না। ‘তা এত সয়ালে আপনি কুহানে
যাচ্ছেন?’
‘রাত্তিরি স্বপ্নে দেখলাম যে ওই পাড়ায় নাকি
উলাবিবি আয়ছে। তাই ভাবলাম যে যাই, এটটু দেহে আসিগে।’
‘সে বিটি অহন কুহানতে আসফে? সে ত ম্যালাকাল
আগেই মরে গেছে।’
‘হঅ, তাই ত মানষি কয় শুনি। তবু যাই এটটু
দেহে আসিগে।’
সামনে এগিয়ে আমি যেন আবার দিক হারালাম।
একটা বড়সড় ধানখেত ও ইটের রাস্তার মাঝখানে খুদে রুক্ষ মৃতপ্রায় একটা বাঁশঝাড়। প্লাস্টিক
আর রড-সিমেন্ট একে উত্তমরূপে ঠেঙ্গাইছে বোঝা যাচ্ছে।
‘কিডা, শ্যাখের বিটা নাকি?’ ছেলেকোলে রাস্তায়
এসে দাঁড়াল এক যুবক। কে এ। আমি কি একে চিনি নাকি।
‘কী ব্যাপার, চিনতে পারলে না বুঝি?’
‘ইনাম ভাই নাকি?’
ছেলেকে নিচে নামিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
‘তোর কথা সব সুমায় ভাবি। গিরামের কথা এইভাবে কেউ ভুলে যায় জীবনে শুনি নেই। যারা বিদেশ
যায় তারাও ত দেহি যে দুই-তিন বছর পরপর গ্রামে আসে। বাড়িঘর বানায়, জমি কেনে, বিয়ে করে
আবার চলে যায় আবার ফিরে আসে। আর তুই সেই যে গিলি—একযুগ কি তারচেয়ে বেশি হইয়ে গেল কিন্তু
তোর আর কোনো খবর নেই।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাখলাম।
‘এই দেখ, আমার ছায়াল কত বড় হইয়ে গেছে। হাঁটা
শিহিছে। শালার বিটা এত বড় হইছে—তবু খালি কোলে উঠতি চায়।’
আশপাশের বাড়ি থেকে আরো কিছু ছেলেবুড়ো এসে
ভিড় জমাল। কিন্তু আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি শুধু উত্তর দিকে চেয়ে আমাদের
বাড়িটা খুঁজছি। সুবৃহৎ কাঠের ঘরটা অনেক দূর থেকেই ত দেখা যেত। এখন সেদিক থেকেই এক দাম্ভিক
দালান আমাকে বিব্রত করছে। কার ওটা? আমাদের বাড়িটা ঠিক ওখানেই ছিল এমন কিছুও ভাবতে পারছি
না। আমি বরং ভাবতে চেষ্টা করছি আমাদের বাড়িটা ওর আগে না পরে। কিন্তু এই ভাবনা আমাকে
অস্বস্তি দেয়, বিব্রত করে। কাউকে কি জিগানো যায় যে ভাই আমাদের বাড়িটা কোথায়।
এক তরুণী প্রায় দোড়োতে দোড়োতে এল যার ওড়নাটা
পিঠে ঝুলানো। ‘শুনলাম যে আপনি নাকি রাস্তা থেকেই আবার ফিরে যাচ্ছেন, তাই দোড়োয় আসলাম।’
তার হাসিমুখে কৌতুক ঝরে পড়ছে। কে এই তরুণী। আমার চাচাত রুজানা?
‘চিনতে পারলেন না বুঝি?’
‘রুজানা। তুই ত খুব মজা করে কথা বলা শিখেছিস?’
‘কই মজা করলাম?’
‘কে বলল যে আমি রাস্তা থেকেই ফিরে যাচ্ছি?’
রুজানা হেসে ফেলল। কিন্তু সে আমাকে কোথায়
নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে এই সকালবেলা আমার মা হাঁস-মুরগির খোপ খুলে তাদের খাবার দিচ্ছে
আর একদল মাদি হাঁস তীব্র প্যাকপ্যাকে সারা বাড়ি মাথায় করছে, বাপ সেই সুবৃহৎ কাঠের ঘরের
বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসে সুদের ব্যবসার নথিপত্র ঘাঁটছে, লাল মদন তার পাশে বসে লেজ
নাড়াচ্ছে? কিন্তু আমার গন্ধ পেয়ে তার ত ছুটে আসার কথা। হয়ত সে আমাকে ভুলে গেছে। অবশ্য
সে মূলত বাপেরই ভক্ত। বাপ সারাদিন যত জাগায় সুদ আদায় করতে যায় সেখানে সে তার ছায়ার
মত লেগে থাকে আর বাপ যার দিকে তর্জনী তুলে ধর বলে তাকেই শায়েস্তা করে।
ইটের রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে গেলে ডানপাশে
বড় একটা পিয়ারা গাছ। আমাদের সুবৃহৎ কাঠের ঘরটার পাশে এরকম একটা গাছ ছিল। কিন্তু আশপাশে
কোথাও কাঠের ঘর নেই ত। পিয়ারা গাছের নিচ দিয়ে আমরা ওই দাম্ভিক দালানটার ডানপাশ ঘেঁষে
বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম।
দালানের বারান্দায় আমার ভুঁড়িঅলা বাপ হাতলচেয়ারে
বসা। টেবিলে রাখা নথিপত্রের দিকে চেয়ে।
এই বাড়িতে কোনো হাঁস-মুরগি নেই, মদন নেই।
এমনকি এই সকালবেলা মাকেও দেখছি না। সেই বাঁশের বেড়া দেওয়া টালির চালের রান্নাঘরটাইবা
কই। এই সকালবেলা সেখানে কোনো সাড়া থাকবে না? ধোঁয়া উড়বে না?
‘আব্বা ভাল আছেন?’
বাপ মুখ তুলল। কিন্তু আরো গম্ভীর। ‘আমরা
ভাল আছি কি মন্দ আছি তা দিয়ে তুমার কী দরকার?’
রুজানা আমার দিকে চোখ বড় করে তাকাচ্ছে।
যেন গভীর কৌতুকে ভাবছে দেখি আমি কী বলি। কিন্তু আমি ভাবছি এখনও আমি মাকে দেখছি না কেন।
হঠাৎ আমার বুকের ভিতর ছ্যাৎ করে উঠল। মা নেই? আমি তাড়াতাড়ি রুজানার দিকে তাকালাম।
‘মা কুহানে?’ আমি ভাবছিলাম রুজানার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে যাবে। কিন্তু সে বরং ‘ওই ঘরে’
বলল।
আর বাপ বলে কিনা, ‘মারে দিয়ে কী অরবা? যিহানে
গিছিলে সেহেনি যাওগে চইলে। বাড়ি আসতি কইছে কিডা?’
‘কাকা থামেন ত। কহন কী কন না কন।’ রুজানা
বাপকে একেবারে শাসন করে দিল। বাপও চুপ।
আমি অবাক হই বাপের উপর রুজানার দখল দেখে।
ছেলেবেলা আমরা চাচা ত দূরের, বাপের সামনেও কথা পর্যন্ত বলতাম না, সেখানে রুজানা তার
চাচাকে যেন মোটামুটি একটা ধমকই দিল।
রুজানা আমাকে মার কাছে নিয়ে যায়। মা খাটে
বসে তসবি টিপছে। আমাকে যেন দেখতেই পেল না। তার চোখ-কান দুইই যায় যায়। আমার গলা জড়িয়ে
যাচ্ছে।
‘মা—!’
‘শুকুর আলি—!’
মা খাট থেকে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে পড়ি পড়ি।
আমি ধরে সামলাতেই হাউমাউ করে উঠল। আমি ছিলাম না বলে তার নাকি মরার কাজটা পর্যন্ত থেমে
আছে। তবে একটু পরেই তার চোখ-কান দুইই প্রায় ফিরে এল। হাত-পাও শক্ত হয়ে উঠল। ততক্ষণে
সারা পাড়া এসে আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমি যেন নতুন জামাই।
কিন্তু কাঠের ঘরটার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে
পারছিনে। তার কোনো অস্তিত্বও দেখছিনে। মা বলল, ‘ঘরটা তুমার বাপ বেচে ফেলিছে। এমন নিষ্ঠুর
মানুষ দুনিয়ায় দেহিনি।’
রুজানা বেলের শরবৎ নিয়ে হাজির। আমি এক চুমুকে
সাবাড় করলাম।
‘এবার ওয়াশ রুমে যান। ফ্রেশ হয়ে আসেন। খেয়েদেয়ে
পরে সারাদিন গপ্প করতে পারবেন।’
আমি অবশ্য গপ্প করছিলাম না। শুধু অন্যদের
নানা প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মাঝে মাঝে মৃদু হেসে মাথা নাড়াচ্ছিলাম আর হুঁ-হাঁ। আমার
নীরবতার উত্তর হিসেবে তারা নিজেরাই বলাবলি করছিল, ‘অত দূরিত্তে কেবল আলো, অহন কি আর
কথা বলতি মন চায়।’
আমি গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একযুগ পরে
পুকুরে লম্বা সাঁতার দেব। কিন্তু এ কী—। এটা কি আমাদের সেই ডালিম দানার মত জলটলমল পুকুর।
এর পানি কি আসলে পানি। নীলচে রাসায়নিক তরলে ভরা যেন পুকুরটা। একেই বলে মাছের খামার?
বাপের দাম্ভিক দালানটায় আধুনিক শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ির
সব বৈশিষ্ট্য টায়েটায়ে। দেখেই বোঝা যায় গ্রাম্য মিস্তিরির কম্ম নয়। নড়ালের প্রকৌশলী
ও শহরের সবচেয়ে দামি মিস্তিরিরা এসে বানিয়ে গেছে। কিন্তু আমি ভেবে পাই না বাপ এত টাকা
কই পায়। তার আত্মাইবা এত বড় হবে কিবায়। যে বাপ আমাদের কারো জন্য কোনো দিন ভাল কাপড়
পর্যন্ত কিনত না। যেকালে প্রায় সবাই বলপয়েন্ট কলমে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সেকালে বাপ আমাকে
ঝরনা কলম কিনে দিত, পুরনো খাতা জমা করে রাখতে হত নতুন খাতা পাওয়ার আগে। খাতার প্রথম
পৃষ্ঠায় মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা লিখে রাখত। ছিঁড়ে গেলে কি যে বিপদ ছিল। গ্রামের প্রথম আদমি
হিসেবে আমি মাধ্যমিক পাশ দিলে হঠাৎ তার মধ্যে অনেকখানি আবেগ জেগে ওঠে, আমাকে একটা হিরো
সাইকেল কিনে দেয় বটে, তিন হাজার টাকা ব্যয় করার দুঃখ তাকে কুরে খেয়েছিল মাস ছয়েক। সেই
বাপ নাকি বিশ লাখ টাকা ব্যয় করেছে এই দালানে পাছে।
আমি এর লম্বা গামলাটার ভেতরে শুয়ে পড়ব নাকি
খাড়া হয়ে শাওয়ার ছাড়ব ভেবে পাই না।
আমি সেই কাঠের ঘরটা ফিরে পেতে চাই।
কি ন তু।
যারা কিনেছে তারা ত তাকে আর ঘর রাখেনি।
কাঠ খুলে নিয়ে ফার্নিচার বানাইছে। যেগুলো ফার্নিচার হয়নি সেগুলো জ্বালানি হইছে।
নতুন একটা কাঠের ঘরও আমি আর বানাতে পারব
না। কোথায় বানাব। সেখানে এখন বাপের দাম্ভিক দালানটা আকাশে মাথা উঁচু করে ঘোষণা দিচ্ছে,
এ এলাকায় আমিই সেরা।
আমি কি অন্য কোথাও গিয়ে একটা কাঠের ঘর বানাব
নাকি। কিন্তু এই মাটি আর এই পিয়ারা গাছটা আমি কিবায় নেব।
—0—